ছড়ায় গণমানুষের দ্রোহবোধে আবিদ আজম
‘আপনারা/দিলেন কেন সাপ নাড়া/সাপ হাকালো ফোস/তাও আমাদের দোষ।’—দেশদ্রোহী/আবিদ আজম (খসড়া ছড়ার পসরা, ২০১২)
এক যুগ আগেই ছড়াশিল্পী আবিদ আজম তার ছড়ার বই খসড়া ছড়ার পসরার ‘দেশদ্রোহী’ নামে ছড়ায় যে ক্ষোভের প্রকাশ করেছিলেন জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের সঙ্গে চির প্রাসঙ্গিক যেন এই চার পঙক্তি। একজন কবির দ্রোহের ভাষা আর লেখনির শক্তিমত্তা বিচারে হয়ত এই চার চরণই যথেষ্ট।
ঘটনাচক্র ২ আগস্ট, ২০২৪। প্রবল বষণমুখর দিন। এর মধ্যে থেমে নেই নিরীহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর পতিত স্বৈরাচারের লাঠিয়াল বাহিনীর নির্মমতা। পপুলিস্টখ্যাত দেশের অগ্রজ কবি সাহিত্যিকরা যখন জুলাই গণহত্যা নিয়ে কিছু বলতে, ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিতে ভয়ে তটস্থ বা কেউ কেউ দিচ্ছিলেন নীরব সমর্থন, তখন সতীর্থদের সাথে নিয়ে এই ছড়াকবি আবিদ আজমের আহ্বানে রাজধানীর বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রধান ফটকের সামনে ‘বিক্ষুদ্ধ কবি-লেখক সমাজ’ দাঁড়িয়ে গেলেন জুলাই গণহত্যা বন্ধ ও ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে। পুরো আন্দোলনের সময়কালে যা ছিল কবি-লেখকদের একমাত্র ব্যানার স্মারক।
জাতির ক্রান্তিকালে কবিরাই জাগিয়ে তোলেন জনতাকে, সচেতন করেন জনসমাজকে। সময়ের নির্মোহ বিশ্লেষণে আবিদ আজমরা হয়ত সে কাজটাই করেছেন।
যেকোনো গণবিপ্লব হুট করেই আসে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উৎস অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে ১৫ বছরে পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ থেকে জনসাধারণের মুখ বন্ধ রাখার সব আয়োজন। জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে বারবার। গণহত্যার দোসর দলদাস কবি-লেখকরাও মুড়ি-মুড়কির লোভে মুখে কুলুপে এটেছিলেন। কঠিন সে সময়ে জেল-জুলুমের ভয় না করেই দেশপ্রেমের তীব্র চেতনা থেকে আবিদ খসড়া ছড়ার পসরাতে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আবিদ আজমের কণ্ঠে তাই দ্বিধাহীন উচ্চারণ: ‘বন্ধ এখন শান্তি নামের/সকল দ্বার/ইবলিশে আজ স্বাধীন দেশের/দখলদার।’—চলমান/আবিদ আজম
অপশাসন, কখনো আবার মূল্যস্ফীতির যাতাকলে পিষ্ট জনজীবন নিয়ে আবিদ আজম বলে উঠেছেন-‘ডিজিটালে দ্রব্যের এত বেশি দাম/গুগলে ভাতের ছবি রাখো আঞ্জাম।’—ডিজিটালে খাওয়া/আবিদ আজম
‘সবার ভেতর অশান্তি খুব/করছে এখন বিরাজ/কোন দিকে দেশ যাচ্ছে নিয়ে/মন্ত্রী, রাজা ধিরাজ।’—দুখের কথা/আবিদ আজম
গণমানুষের বন্ধু হওয়ার বদলে পুলিশ যে দানব হয়ে উঠছিল, কত আগেই কবি তা উপলব্ধি করেছেন। লিখেছেন, ‘ব্যাটারে যে এ্যারেস্ট করূম/পাইনা কোন ছুতাই/ভীষণ রকম মুন্ডু গরম/ব্যাট দিয়ে তাই গুতাই।/কোনো কথায় কাজ হবে না/রিমান্ডে আজ চল/এই অপরাধ করলি না কেন/বলরে এবার বল।’—সিষ্টেম/আবিদ আজম
তারুণ্যের দ্রোহের আকুতি ছড়ায় ছড়ায় এসেছে বারবার। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে লেখেন, ‘যোদ্ধা বাবার ছেলে আমি যোদ্ধা বাবার ছেলে/নিজেও ঠিক যোদ্ধা হবো সময় সুযোগ এলে/যোদ্ধা বাবার রক্ত আমার এই শরীরে মিশে/দেশের তরে শহীদ হলে কান্না তবে কি সে।’—যোদ্ধা বাবার ছেলে/আবিদ আজম
জুলাই গণ আন্দোলনে তারুণ্যের অভিপ্রায় খুঁজতে গেলে রীতিমতো মিলে যাবে আবিদের খসড়া ছড়ার পসরার আরেক ছড়া ‘রান্না আগুন’ এর সাথে। দুই দশক আগেই নিপীড়িত, দমিয়ে রাখা তারুণের ক্ষোভ-ক্ষুধা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন একজন ছড়াশিল্পী। আবিদ লেখেন, ‘মা তোর ছেলে/চায় যেতে চায় যুদ্ধে/আনতে আসল স্বাধীনতা/খোকার মুখে দুধ দে।/স্বাধীনতার এই নমুনায়/নেই বুঝি তার তুষ্টি,/ ঐ চেয়ে দেখ নতুন করে/বাঁধছে আবার মুষ্টি/খোকার মুখে ক্ষোভের আওয়াজ/হাজার দ্রোহের কান্না,/ খাবার ফেলে মা তুই এবার/করবি আগুন রান্না’—রান্না আগুন/আবিদ আজম
শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি ও ছড়াশিল্পী আবিদ আজম। তবে দুই দশক ধরেই ঢাকাইয়া সাহিত্য সড়কে সম্ভাবনায় উজ্জল মুখ। কখনো ছড়ার স্রষ্টা, কখনো গল্পকার কখনোবা টেলিভিশনের মুগ্ধ উপস্থাপনা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একজন আবিদের পরিচয় সাহিত্যের মায়াজালে বিচরণশীল লাল সবুজের প্রেমে উদীপ্ত-স্বপ্নচারী। দলদাস আর দলকানা বুদ্ধিজীবীদেরও ছাড়েননি আবিদ। ছড়ায় ছড়ায় বলেছেন, ‘বলছি হ্যালো কলাম লেখক বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতও/এক জাতিকে হাজার ভাগে করেন কেনো খন্ডিত/পাপ ছেড়ে খুব নেক করেন/গোয়ার্তুমী ত্যাগ করেন/তা না হলে ইতিহাসে হতেই হবে দণ্ডিত।’
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নবীন অনুসারী হিসেবে তরুণ ছড়াকার ও সাংবাদিক আবিদ আজম। আওয়ামী দু:শাসনকালে সরকারের যে দমন-পীড়ন নীতি তার অন্যতম ভুক্তভুগী ছিলেন লেখক, সাংবাদিকরা। আবিদ সেই কষ্টের কথাও তুলে এনেছেন তার ছড়ায়। তিনি বলেছেন, ‘ভালো ভালো কাজ যতো/আজ শুধু তা হতো/স্বদেশের হাল দেখে/হতাম না আহত।’—আক্ষেপ/আবিদ আজম
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য্যবোধ ও নজরুলের চেতনার অনুসারী হিসেবে আবিদ বরাবরই বিশ্বাসের প্রতিনিধি। কবি লিখেছেন, ‘আমি যদি ঠিক থাকি ভাই/ন্যায়ের পথে চলি/হৃদয়জুড়ে ফুটবে সুখের/
লক্ষ গোলাপ কলি।’—আত্মসমালোচনা/আবিদ আজম
মা মাটি মানুষ কবি আবিদ আজমের সবসময়ের ভালোলাগা ও চর্চার কেন্দ্রভূমি। সবখানে তিনি রোপণ করতে চান সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বীজমন্ত্র। তার বিশ্বাস ভালোবাসা দিয়েই নির্মিত হবে পৃথিবীর সব বাসাবাড়ি-সবুজ সংসার।