ফুল নিবেদনে শুরু বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা

সবেমাত্র তখন পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। আর এরই মধ্যে রাঙ্গামাটি কেরানি পাহাড় এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের তীরে হাজির হয়েছেন শত-শত পাহাড়ি তরুণ-তরুণী। ঐতিহ্যবাহী পিনন-হাদির পোশাকে তরুণী এবং ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হাতে ফুল, পাতা নিয়ে তরুণরা ছুটে চলছে কাপ্তাই হ্রদের তীরে। তীরে গঙ্গা মায়ের উদ্দেশে ফুল উৎসর্গ করে কলা পত্র করে সেই ফুল পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন তারা।
এই উৎসবটি চাকমা জনগোষ্ঠী ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হারিবসু’ আর মারমা জনগোষ্ঠী ‘সূচিকাজ’ নামে পরিচিত। ঠিক ফুলবিজু নামে অভিহিত না হলেও এইদিন প্রায় সকল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীই পানিতে ফুল ভাসানোর আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
তবে শুধু কেরানী পাহাড়ে নয়; জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়িরা ফুল ভাসিয়ে দিনটি শুরু করেছেন। ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফুলবিজু উপলক্ষে শহরের রাজবন বিহার ঘাট, গর্জনতলী মধ্যদ্বীপসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এবং ব্যক্তিগত উদ্যেগে পানিতে ফুল ভাসানো হয়। পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিজ পরিবার এবং দেশ তথা সমগ্র জীবের মুক্তির জন্য গঙ্গা দেবীর নিকট প্রার্থনা করা হয়। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাই যেনো ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালান পাহাড়ের বাসিন্দারা। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল ভাসাতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা।

কাপ্তাই হ্রদে ফুল নিবেদন করে অনিতা চাকমা বলেন, ফুল বিজুর দিনে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন আমাদের ঐতিহ্য। পাশাপাশি আজকে থেকেই বর্ষবরণের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আগামীকাল মূল বিজু এবং পরশু পহেলা বৈশাখ পালন করব। ফুল নিবেদন করে আমরা গঙ্গাদেবীর কাছে সুখ ও সমৃদ্ধি প্রার্থনা করি।
এ বিষয়ে হৃদয় চাকমা বলেন, পুরোনো দিনের দুঃখ, গ্লানি দূর করে নতুন বছর যাতে সবার জীবন আলোকিত ও মঙ্গলময় করে তুলে সেজন্য ফুল নিবেদন করেছি। পানির প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতাবোধ সেটা জানানোর লক্ষ্যে এই আয়োজন।
রাজবন বিহারের পূর্ব ঘাটে বিঝু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু-সাংক্রাই-চাংক্রান-পাতা উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কাপ্তাই হ্রদে ফুল নিবেদনের মাধ্যমে তাদের চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষ করেছে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, বিজু মানে চেতনা, বিজু মানে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলার প্রেরণা দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যে বঞ্চনা, লাঞ্চনা শিকার হয়েছেন, সেটা দূর হয়ে একসাথে পথ চলার শক্তি এই বিজু। বিজুর মাধ্যমে সকলের মাঝে কল্যাণের বার্তা পৌঁছে যাক।
হ্রদে ফুল নিবেদনের পর তরুণ-তরুণীরা বাসায় গিয়ে ফুল, নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজিয়ে তুলে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা ঘর ও এলাকার মুরব্বিদের ম্লান করে নতুন কাপড়ের মাধ্যমে বরণ করে নেয়। এ সময় তারা মুরব্বিদের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। আগামীকাল রোববার বছরের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে পাঁজন আতিথেয়তা এবং পরের দিন নববর্ষে বিহারে বিহারে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বছরের প্রথম দিন সোমবার জলকেলির মাধ্যমে মারমারা সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন করবে। বৈসাবি উপলক্ষে গত দশদিন ধরে চলছে মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলাসহ আরো নানান আয়োজন। যা আরো এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’ সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়।