আইসের বড় চালান : মূলহোতাকে চিহ্নিত করে আদালতে অভিযোগপত্র
গত বছরের ৮ অক্টোবর; রাত তখন আনুমানিক পৌনে ১টা। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের তেমহুনী এলাকায় মিনি ট্রাক থামিয়ে শুরু হয় তল্লাশি। দৌড়ে পালানোর সময় এক রোহিঙ্গাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গাড়িতে মেলে দুই কেজি মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। এত বড় অঙ্কের মাদকের চালান ধরা পড়ায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। মামলা তদন্তে উঠে আসে নেপথ্যের কুশীলবদের নাম। গ্রেপ্তারও হন কেউ কেউ। তবে, মিয়ানমার থেকে আনা আইসের মূল হোতা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অবশেষে মূল কারবারিকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে দাখিল করা হয়েছে অভিযোগপত্র। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও থানার পরিদর্শক সুজন কুমার দে এ অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগে বলা হয়, আটক আহমদ ওরফে ফয়সাল (৩৩) ও জাহেদ আলমকে (২০) আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিলে তাঁরা মাদকের এ চালান রাজধানী ঢাকায় নেওয়া হচ্ছিল বলে জানান। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম প্রকাশ করেন। পরে তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সূত্রে প্রকাশ, গত বছরের ৮ অক্টোবর রাতে ঢাকা মেট্রো-ড-১১-৯৩৪২ নম্বরের মিনি ট্রাককে সিগন্যাল দিয়ে থামানো হয়। পরে ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার দুই কেজি আইস জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করলে টেকনাফ উপজেলার কচ্ছপিয়া এলাকার ফয়সাল ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৭-এর বাসিন্দা জাহেদ পুলিশের হাতে আটক হন। এ সময় মাদক বহনকারী ট্রাকটি জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় এসআই জাকির হোসেন ওই রাতেই বাদী হয়ে থানায় মামলা (১১/২৯০) করেন। মামলাটির তদন্তভার পান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজন কুমার দে।
গ্রেপ্তার করা ফয়সাল ও জাহেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মামলার পলাতক আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দিদার হোসেন দিলদারকে (৩১) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এবং পরে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দিলদার জানান, চকরিয়া পৌরসভার মাইজপাড়া এলাকার মো. রহমত উল্লাহ টেকনাফ পৌরসভার পল্লাং পাড়ার আজিজ উল্লাহর (৩১) দোকান থেকে আইস নিয়ে দিলদারকে দেন। এগুলো তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর কথা বলা হয়। পরে সেগুলো ঢাকায় পাঠানোর জন্য ফয়সাল ও জাহেদকে দেন দিলদার।
দিলদারের দেওয়া তথ্যে পরে আজিজ উল্লাহ ও রহমত উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আজিজ ও রহমত ১১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সে জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয় ভয়াবহ মাদকের রুট। সেইসঙ্গে উঠে আসে মূল মাদককারবারী শাহ আলম প্রকাশ ছালেমের নাম। জানা যায়, টেকনাফের আরও এক মাদক কারবারি মীর আহমদের নাম। বলা হয়—প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আসে এসব মাদক।
অভিযোগপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে দফায় দফায় হাত বদল হতে থাকে মাদকের চালান। দুই কেজি আইস রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছাতে চট্টগ্রাম পার হওয়ার আগেই বদল হয় পাঁচ হাত। শাহ আলম ওরফে ছালেমের শ্যালক আজিজ উল্লাহ ওই ১০ কোটি টাকার দুই কেজি ক্রিস্টাল মেথ পুলিশের হাতে আটক রহমত উল্লাহকে দেন। এরপর রহমত উল্লাহ আইসগুলো ঢাকা পাঠানোর জন্য দিলদারকে দেন। পরে দিলদার ফজল আহমদ ওরফে ফয়সালকে দেন। ফয়সাল পুলিশের হাতে জব্দ গাড়ির হেলপার জাহেদ আলমকে নিয়োগ করেন।
এভাবেই ঢাকায় প্রবেশের কথা ছিল ১০ কোটি টাকা মূল্যের ভয়ানক মাদক। তার আগেই পুলিশ আইসের বিশাল চালানটি জব্দ করে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।
ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার এবং পরবর্তীকালে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে সাতকানিয়া সার্কেলের সে সময়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্তমানে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত) জাকারিয়া রহমান জিকুর কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে এই বিশাল অঙ্কের মাদক উদ্ধারের পর পরই আমরা এর পেছনে থাকাদের গ্রেপ্তারে কাজ করি। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। বেশির ভাগ আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।’
অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানার পরিদর্শক সুজন কুমার দে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্তের দায়িত্বভার নেওয়ার পর থেকে ভয়ানক এ মাদককারবারিদের আইনের মুখোমুখি করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এর সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও মিয়ানমার থেকে ক্রিস্টাল মেথ দেশে আনা শাহ আলম ওরফে ছালেমকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এ মামলায় মীর আহমদ নামের আরও এক আসামি পলাতক রয়েছেন।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারেক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমি সাতকানিয়ায় যোগদান করার আগেই সুজন কুমার দে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছেন। সে সময়ে দুই কেজি ক্রিস্টাল মেথ মাদক উদ্ধারের ঘটনা ছিল বাংলাদেশের জন্য সর্ববৃহৎ ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধারের ঘটনা। এটির সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ মাদককারবারিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।’