ওসি দীপক চন্দ্র সাহা আমার সন্তান : সিসিইউয়ে ভর্তি হাবিবুর রহমান
শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হাবিবুর রহমান (৭৫)। ভেন্টিলেটর মেশিনের মনিটর থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে বিপ বিপ শব্দ। এর মধ্যেই নিয়ম করে তাঁকে দেখতে আসেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। সঙ্গে নিয়ে আসছেন ফলসহ নানা পথ্য। নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন তাঁর চিকিৎসার। দফায় দফায় পরিশোধ করছেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ওষুধের বিল।
ওসি যখন আসেন। বৃদ্ধ দম্পতির মুখে তখন রাজ্যের হাসি ফোটে । আবেগাপ্লুত কিছু মুহূর্তের অবতারণা হয়। ওসি চলে যাওয়ার পর ওই বয়স্ক দম্পতির চোখের সামনে যেন নেমে আসে গভীর এক শূন্যতা। এ নিয়ে নানা কৌতূহল কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে।
কে এই ওসি? শুনেছি রোগীর বাবা ওসি সাহেব- সরল উত্তর আসে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কণ্ঠ থেকে।
তবে খটকা লাগে বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের চিকিৎসার ফাইল দেখে। যাকে নিয়ে এত কৌতূহল তিনি হলেন সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা।
পিতা আর সন্তান? কীভাবে! সহজ এই সম্পর্কের বিষয়টা তখন একটু গোলমেলে হয়ে ওঠে।
কারণ হাবিবুর রহমান তো মুসলমান! ভুরু কুঁচকে যাওয়া এমন কৌতূহল থেকে বেরিয়ে আসে স্নেহ, মমতা আর বন্ধনের অসামান্য এক গল্প।
একজন নার্স এগিয়ে এসে কৌতূহল ভেঙে দিয়ে বলেন, ‘আমার কর্ম জীবনে এমন বন্ধন খুব কমই দেখেছি। আসলে সন্তানের চাইতেও ওসি সাহেব বেশি কিছু। কারণ এই দম্পতি সব সময় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকেন, কখন আসবেন ওসি সাহেব। যেন তিনিই ডাক্তার। ওসি সাহেব যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ প্রফুল্ল থাকেন এই দম্পতি। অদ্ভুত না বিষয়টা?’
আদতে দুজনের ধর্ম ভিন্ন। উৎসব তো বটেই। এসব কিছু ছাপিয়ে স্নেহ, মমতার বিপরীতে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বন্ধনের অসাধারণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাভার মডেল থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা।
‘উনারা আপনার বাবা-মা?’ ওসি দীপক চন্দ্র সাহাকে এমন প্রশ্ন করতেই সহাস্যে উত্তর দেন, ‘তার চাইতেও বেশি কিছু।’
ওসির কথায় বেরিয়ে আসে একজন সন্তানহীন বাবার শূন্যতা পূরণে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর সন্তানের চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠার গল্প। দীপক চন্দ্র সাহা তখন ধামরাই থানার ওসি।
২০১৮ সালের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘মৃদুল মাহমুদ সাদ্দাম (২৪)। বেশ চটপটে যুবক। ছিলেন ধামরাই উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। মানুষের নানা আইনগত সেবার বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসতেন। তাঁর পরোপকারী আচরণে আমিও তাঁকে বেশ স্নেহ করতাম। একদিন সাদ্দাম ধামরাইয়ে ভাড়ারিয়ার চন্দ্রপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানেই পরিচয় বিদেশফেরত তাঁর বৃদ্ধ বাবা হাবিবুর রহমান ও মা রাশিদা বেগমের সঙ্গে।’
দীপক চন্দ্র সাহা আরও বলেন, সাদ্দামের এক বোন জেসমিন আক্তার। স্বামী নিয়ে তিনি থাকেন ধামরাইয়ের নান্নার এলাকায়। তো অল্প পরিচয়ে আমাকে বেশ আপন করে নেন তাঁরা। এর কিছুদিন পর হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান মৃদুল মাহমুদ সাদ্দাম। তারিখটি ছিল ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর। একটি পরোপকারী তরুণ এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নিজেও হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। সান্ত্বনা দিতে ছুটে যাই তাঁদের বাসায়। সন্তানহারা মা-বাবার সেদিনের শোকার্ত আর্তি আমাকে আজও কাঁদায়।’
‘তারপর কী হলো, আমি নিজেও জানি না। তাঁরা আমার মধ্য খুঁজে পেলেন তাঁদের আদরের সন্তান সাদ্দামকে। আমার পক্ষেও মা-বাবার স্নেহ আর মমতার এই বন্ধন উপেক্ষা করার কোনো বিকল্প ছিল না। বলতে পারেন,এভাবেই ধীরে ধীরে আমি হয়ে উঠেছি তাদের সন্তান’ বলেন ওসি দীপক চন্দ্র সাহা।
‘সাভার থানায় এমনিতেই ব্যস্ততার শেষ নেই। এখানে রাত দিন সমান। এর মধ্যেও এই মা যখন ফোন করে বলেন, আজ ভালো মন্দ রান্না করেছি তুমি না এলে তোমার বাবা খাবে না। এমনকি ঘুমাবেও না। তখন যত রাতই হোক না কেন, না গিয়ে আর উপায় থাকে না। চাকরি জীবনের ব্যস্ততার কারণেই আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার তেমন সুযোগ হয় না। কিন্তু এই মা-বাবার টানে অবসর পেলেই আমাকে ছুটে যেতে হয়। না গেলে তাঁরা অস্থির হয়ে ওঠেন। আমার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছেও এখন তাঁরা আপনজন।’
সন্তান হিসেবে দীপক চন্দ্র সাহার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাবিবুর রহমানের।
বলেন, ‘এমন সন্তান যাতে আল্লাহ প্রতিটি মা-বাবার ঘরে দেন- ঘরগুলো আলোয় ভরে উঠে। সন্তান হিসেবে দীপক চন্দ্র সাহাকে পেয়ে সবসময় এই দোয়া করি আল্লাহর কাছে।’
কথা হয়, রাশিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন ‘দীপক আমাগো পোলা। আল্লাহ আমাগো সাদ্দাম রে লইয়া গেছে, কিন্তু দীপক রে পাঠাইয়া আমাগো শোক তাপ- সব ভুলাইয়া দিছে। আমাগো চিকিৎসা থেকে শুরু কইরা ঈদের আনন্দে নতুন জামা-কাপড় সবকিছু ও দেয়। সন্তানের চাইতেও অনেক বেশি কিছু করে। ওর মতো সন্তান যে মায়ের তার পৃথিবীতে আর কোনো কষ্ট থাকে না।’
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক (হাসপাতাল) আশরাফ উল্লা চৌধুরী সাইফুল বলেন, ‘আমরা তো এত দিন জানতাম হাবিবুর রহমান ওসির বাবা। যেভাবে তিনি সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেন, পাশে থাকেন, এই যুগে সন্তানদের নিজের মা-বাবার যত্ন আত্তির উদাহরণ খুব কম দেখি।’
প্রকৃত সম্পর্কের বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করে সাইফুল বলেন, ‘এই যুগেও মানুষ এমন হয়! সত্যিই অবাক করার মতো ঘটনা।’
সমাজে যখন আত্মার সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। ক্রমশ বিষাক্ত ও বন্ধনহীন হয়ে উঠছে একে অন্যের সম্পর্ক। যেখানে এখনও সম্পদের কারণে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক পরিণত হয় চরম শত্রুতায়, সেখানে ভিন ধর্মের হয়েও নিখাদ নিঃস্বার্থ এমন সম্পর্ক জানান দেয় ভিন্ন বার্তা।
সন্তানহারা মা-বাবার সন্তান হারানোর শূন্যতা পূরণের এমন অবলম্বন হয়ে মানবিকতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ওসি দীপক চন্দ্র সাহা।
আর এই বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় হাসপাতাল তো বটেই গোটা এলাকায় প্রশংসায় ভাসছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইল জেলার সন্তান ২০০৩ ব্যাচের এই পুলিশ কর্মকর্তা অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন সুদানের দারফুরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। অর্জন করেছেন জাতিসংঘ পদক।
অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা ও অনন্য সাধারণ পেশাদারি প্রদর্শনের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন, অপরাধীদের গ্রেপ্তার, মামলা গ্রহণ, বিচারে সহায়তা, সড়ক শৃঙ্খলা ও ভিআইপি নিরাপত্তা (প্রটোকল), গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াসহ পেশাগত নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য ঢাকা রেঞ্জ থেকে দুবার পেয়েছেন বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ ওসির পুরস্কার।
ধামরাই, নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সাভার মডেল থানার ওসি হিসেবে অসংখ্যবার অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ ওসির পুরস্কার।