ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী হারিছ চৌধুরী, ভোটার হন অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে!
হারিছ চৌধুরী ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হারিছ চৌধুরী। ফলে, গোয়েন্দাদের চোখ এড়াতে তিনি ভিন্ন নাম ধারণ করেন। নাম পাল্টে হয়ে যান মাহমুদুর রহমান।
মাহমুদুর রহমান নামে তিনি নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। নতুনভাবে ভোটার হওয়ার সময় হারিছ চৌধুরী শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখান ‘অষ্টম শ্রেণি’ পাস। পেশা হিসেবে উল্লেখ করেন ‘কৃষক’। স্থায়ী ঠিকানা দেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার। আর, বর্তমান ঠিকানা দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৬/এ নম্বর বাসা।
তবে, মাহমুদুর রহমান যে বাসার ঠিকানা দিয়ে ভোটার হয়েছিলেন, বাস্তবে ওই ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। রাজধানীর মিরপুরের মণিপুর এলাকায় ৫৬ ও ৫৭ নম্বর বাসা থাকলেও ৫৬/এ নম্বর নেই। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটি ভেঙে ফেলে নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। ৫৬ নম্বর বাসার মালিক আরিফুল আলম।
আরিফুল আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার জানা মতে, ৫৬/১ নম্বর থাকলেও ৫৬/এ নম্বর বাসা নেই। কখনো শুনিনি, এখানে এ ঠিকানার বাসা আছে। আর, মাহমুদুর রহমান নামের কাউকে আমি চিনি না।’
হারিছ চৌধুরী থেকে মাহমুদুর রহমান হয়ে ওঠা ব্যক্তির নতুন ভোটার হওয়ার জন্য শনাক্তকারী ছিলেন শামীমা নাসরীন। শুধু তাই নয়, মাহমুদুর রহমানের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিস্তারিত তথ্যে যে মুঠোফোন নম্বরটি দেওয়া হয়েছে, সেটি এখনও ব্যবহার করছেন শামীমা নাসরীন। শামীমার স্বামীর নাম জাফর আহমেদ লস্কর। জাফর আহমেদের আপন দুলাভাই হলেন হারিছ চৌধুরী।
শামীমা নাসরীন বলেন, ‘আমার স্বামীর দুলাভাই হারিছ চৌধুরী। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল হারিছসহ তাঁর পরিবারের সঙ্গে। কোনো একদিন হারিছ চৌধুরীর এক ভাই আমাকে বললেন, তোমার মোবাইল নম্বরে একটি কোড যাবে। কোডটি দিও। তারপর কোড আসে। সেটি আমি আবার উনাকে দিয়েও দিই। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ব্যবসায়িক কোনো কাজে লাগতে পারে। সর্বশেষ তিন-চার দিন আগে আমার কাছে এক পুলিশ কর্মকর্তা ফোন করে এ ঘটনা জানান। তখন আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। অথচ আমি এসবের কিছুই জানতাম না।’ যদিও শনাক্তকারীর স্বাক্ষর রয়েছে আবেদনে।
নির্বাচন কমিশনে মাহমুদুর রহমান তাঁর জন্ম নিবন্ধনের কাগজ জমা দেন। জন্ম নিবন্ধনটি ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে নেওয়া। জন্ম নিবন্ধনের নম্বর ১৯৫৫২৬৯২৫১৪০১৪১৯৮। এখানে মাহমুদুর রহমান তাঁর বাবা ও মায়ের নাম দিয়েছিলেন আবদুল হাফিজ ও রোকেয়া বেগম। স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। ১৯৫৫ সলের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হারিছ চৌধুরী। এ ছাড়া ভোটার হতে আরও যেসব কাজগপত্র ইসিতে জমা দেওয়া হয়েছে, সেসবের খোঁজ করা হচ্ছে। কমিশন এটার তদারকি করছে।
রাজধানীর মিরপুরের নির্বাচন অফিসে যখন আবেদন জমা দেন মাহমুদুর রহমান, তখন, অর্থাৎ ২০১৮ সালে, মিরপুর থানার নির্বাচন কর্মকর্তা ছিলেন রাকিবুজ্জামান রেনু। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান জন্ম নিবন্ধনের কপি জমা দেন। তা অনলাইনে ছিল। যিনি শনাক্ত করেছেন, তাঁর সবকিছু অনলাইনে রয়েছে। উনি যে পাসপোর্ট নম্বর দিয়েছেন, সেটি ঠিক আছে। হোল্ডিং নম্বরে গিয়ে হয়তো তদন্ত করা হয়নি। সীমিত লোকবল নিয়ে বাসায় বাসায় যাওয়া তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেজন্যই বিদ্যুৎ বিলের কপি জমা নেওয়া হয়।’
হারিছ চৌধুরী ওরফে মাহমুদুর রহমান যখন নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেন, তখন তাঁকে রেফার করেছিলেন সে সময়ের টঙ্গী থানার নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুল হক। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে তিনি মিরপুর থানার নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। মাসুদুল এখন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত।
মাসুদুল হক বলেন, ‘মাহমুদুর রহমানকে আমি চিনি না। কখনও দেখিওনি। কেউ একজন হয়তো আমাকে বলেছিলেন, আবেদনটা যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেটা দেখতে। হয়তো তিনি আমার পরিচিত ছিলেন। আমিও রেফার করে দিয়েছি। কে বলেছিলেন, তাও মনে নেই। এমন ঘটনা একটি হলে হয়তো মনে থাকতো। কিন্তু, পরিচিতজনদের জন্য তো মাঝেমধ্যেই রেফার করতে হয়। আমি মিরপুরে লেখাপড়া করেছি। ওখানে আমার অনেক পরিচিতজন আছেন। তেমন কেউ হয়তো হবে। এ ঘটনা যখন সামনে এলো, তখন আমি জানলাম বিষয়টি। তারপর থেকে মনে করার চেষ্টা করেও পারেনি।’
বর্তমানে মিরপুর থানা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাকে জানানো হয়েছে। ভোটার হওয়ার সময় যে ফাইলগুলো দিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান, সেগুলো খোঁজা হচ্ছে। চার-পাঁচ জন মানুষ খুঁজছে। লাখ লাখ ফাইল, খুঁজতে সময় লাগছে। তবে, পাওয়া যাবে।’
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, হারিছ চৌধুরীর নামে কোনো তথ্য ইসির কাছে নেই বা ছিল না। তিনি মূলত নাম গোপন করে ভিন্ন নামে প্রথম ভোটার হয়েছেন। তবে, হারিছ চৌধুরীর ভিন্ন নামে এনআইডি পাওয়া নিয়ে বিব্রত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব কাগজপত্র হাতে এলে বিস্তারিত বলা যাবে।’
এদিকে, পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নয়, হারিছ চৌধুরী মাহমুদুর রহমান নামে পাসপোর্টও সংগ্রহ করেন। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। পাসপোর্ট তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল পৌরসভার পাদ্রী-বাংলা রোডের ঠিকানা। পাসপোর্ট পেতে আবেদন করার সময় জরুরি যোগাযোগের অংশে ছেলে হিসেবে ইকবাল আহমেদের নাম রয়েছে। সেখানে একটি নম্বর দেওয়া আছে, যে নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও ফোনটি কেউ রিসিভ করেনি। জানা গেছে, আবেদনে ছেলে হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ইকবাল আহমেদ আসলে হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
যদিও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, মৌলভীবাজারের যে ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট করা হয়েছিল, সে ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। তবে হারিছ চৌধুরী ওরফে মাহমুদুর রহমান স্ত্রীর নাম দেন জোসনা বেগম। জোসনাই হারিছের প্রকৃত স্ত্রীর নাম। মাহমুদুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বর BW0952982। এ পাসপোর্ট তিনি কীভাবে পেয়েছেন, তা নিয়ে অধিদপ্তরটি তদন্ত করছে।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর হারিছ চৌধুরী ওরফে মাহমুদুর রহমান মারা যান রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। যদিও চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই কামাল চৌধুরীর শ্যালক মইনুল হক বুলবুল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘তিন মাস আগে লন্ডনের একটি হাসপাতালে হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন।’
তবে, গত ১৫ জানুয়ারি হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরীর বরাতে মানবজমিন খবর দেয়, ‘হারিছ চৌধুরী গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান।’
মানবজমিনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওয়ান ইলেভেনের পরপরই কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করেন। ঢাকায় আসার পর তিনি নাম বদল করেন। নাম রাখেন মাহমুদুর রহমান। দীর্ঘ ১৪ বছর এ নামেই পরিচিত ছিলেন। পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকার পান্থপথে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে দেন এ পরিচয়ে। এ সময় তিনি মাহমুদুর রহমান নামে একটি পাসপোর্টও নেন।
এ প্রতিবেদকের কাছে থাকা তথ্য বলছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে দুই ডোজ করোনার টিকা নেন হারিছ চৌধুরী। রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছিলেন ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেন একই বছরের ২৫ এপ্রিল।
জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আশিকুর রহমান জানান, তাঁর পূর্ব পরিচিত জাফর ইকবাল মাসুম নামে এক ব্যবসায়ী গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মাহমুদুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে মাদ্রাসায় দাফনের অনুরোধ করেন। সে সময় মাসুম জানান, মাহমুদুর রহমান নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে কয়েকজন ব্যক্তি এসে মাদ্রাসায় জানাজা শেষে তাকে দাফন করেন। এ প্রতিবেদকের কাছে থাকা মাদ্রাসার অনুদান সংক্রান্ত একটি নথি বলছে, মাহমুদুর রহমানের পক্ষে পবিত্র নামের এক ব্যক্তি মাদ্রাসায় তিন লাখ টাকা দান করেন।