প্রথম আলো সংশোধনী দিয়েছে, তারা আইনগত সুবিধা পাবে : হাইকোর্ট
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ রোববার (২ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টায় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও ইমতিয়াজ মাহমুদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মেহেদী হাসান চৌধুরী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি।
বিকেল সোয়া ৩টায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের পক্ষে শুনানি শুরু করেন ফিদা এম কামাল। আদালতকে তিনি বলেন, ‘মাই লর্ড, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের পক্ষে জামিন আবেদন করছি।’
জবাবে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম জিজ্ঞাসা করে বলেন, ‘কোন ম্যাটারে?’
এ সময় আইনজীবী ফিদা এম কামাল বলেন, ‘মাই লর্ড, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। ৬০ বছরের বয়স্ক একজন আইনজীবী বাদী হয়ে মামলা করেছেন।’
বিচারক আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?’
জবাবে ফিদা এম কামাল বলেন, ‘মাই লর্ড, স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে একটি নিউজ প্রকাশিত হয়। যেখানে একটি শিশুর ছবি প্রকাশিত হয়। ছবির ভুলের কারণে ১৭ মিনিটের মাথায় আমরা সংশোধনী দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছি। এরপর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভির রিপোর্টার ফারজানা রূপা এ নিউজকে মিসগাইড করে আরেকটি নিউজ প্রকাশ করেন। যেখানে বলা হয়, একটি শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে ছবি তোলা হয় এবং স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। এ নিউজ দেখে এ আইনজীবী ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। মামলার বাদী তাঁর এজাহারে বলেছেন, এ নিউজ দেখে তাঁর কাছে মনে হয়েছে, ১৯৭৪ সালে প্রতবিন্ধী বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবি তোলার কথা। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি মামলা করেছেন।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘ওই ঘটনার পর বাসন্তীর কী হলো, তার খোঁজ তো কেউ নিল না। আমরা জানি, প্রথম আলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে প্রথম আলো সবারই আইডল। তাদের স্লোগান আছে সত্যের সন্ধানে। আপনারা যদি এ রকম ভুল করেন, দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেন, তাহলে কী হবে?’
জবাবে মতিউর রহমানের আইনজীবী আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বিষয়টি একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিক পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে রিপোর্ট করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী যে মামলাটি করেছেন তিনি কীভাবে এখানে সংক্ষুব্ধ হলেন, সেটাই তো বুঝলাম না। আমরা মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাটি এখানে প্রয়োগযোগ্য নয়। আবার যিনি মামলা করেছেন তিনি কীভাবে এ মামলা করলেন? তিনি তো মামলার বাদী হতে পারেন না। আজকে আবার তিনি এখানে নেই।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘আমরা মামলার মেরিট নিয়ে এখন শুনব না। কেননা, এখন শুধু জামিন শুনানি। যত দূর জানি প্রথম আলো সব সময় সত্যের পক্ষে নিউজ করে।’
এ সময় মতিউর রহমানের অপর আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, ‘মাই লর্ড, মতিউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সব সময় তাঁদের কলম উঠে। মতিউর রহমান এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরে তিনি ম্যাগাজিন একতাতে কাজ করতেন। তিনি ভোরের কাগজ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং দৈনিক প্রথম আলোর জন্ম দেন। এ দেশে এ পত্রিকাটি সব মিডিয়ার জন্য একটি আদর্শ।’
এ সময় বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম বলেন, ‘প্রথম আলো তাদের ভুলের জন্য সংশোধনী দিয়েছে। এ কারণে তারা আইনগত সুবিধা পাবে।’ আদালত আরও বলেন, ‘আইনের আশ্রয় লাভের জন্য সবার সমান অধিকার রয়েছে।’
মতিউর রহমানের জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘মাই লর্ড, সংশোধনী দিয়ে কী লাভ? যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশে সব জায়গায় জানাজানি হয়ে গেছে। জবাই করার পরে দুঃখ প্রকাশ করে কী লাভ?’
জবাবে আদালত বলেন, ‘যিনি সংক্ষুব্ধ, তিনি তো প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারতেন।’
এ সময় সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘আমি নিজেও প্রথম আলোর পাঠক। প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের পত্রিকা। কিন্তু এসব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কী কাজটি করল প্রথম আলো? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে টালমাটাল, সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সাত বছরের একটি বাচ্চা, সবুজের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছে। পরে এটি প্রত্যাহার করলেও, যা ক্ষতি করার তারা তা করে দিয়েছে। সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘মাই লর্ড, মতিউর রহমান অন্যদের দ্বারা বায়াস্ট হয়ে পরিকল্পিতভাবে এ নিউজ পরিবেশন করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘মতিউর রহমান সাহেব তো নজরে আসার পর ভুল স্বীকার করে সংশোধনী দিয়েছেন। তারা তো রুলস মেইনটেইন করেছেন।’
জবাবে ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘প্রথম আলো সত্যের সন্ধানে নিউজ করে বলে প্রচার করে। কিন্তু এখানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। এখানে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেনি। মতিউর রহমান এটার দায় এড়াতে পারেন না। কেননা তাঁকে সবকিছু মনিটরিং করতে হবে।’
এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরীও জামিনের বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন, ‘প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তো সরকার করেনি। আরেকজন সাংবাদিকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তারা ভুল করল, আবার প্রত্যাহার করল। বিষয়টি এমন যে পকেট মেরে আবার টাকা ফেরত দিল।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘ভুলটা নজরে আসার পর তো তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’
এরপর বিচারক ‘আমরা আদেশ দিচ্ছি’– এ কথা বলে বিচারক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেন এবং এ সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে তাঁকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন।
এর আগে সকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন চান প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। সকালে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি গ্রহণ না করে ফেরত দেন। পরে বিকেল ৩টায় অপর বেঞ্চে জামিন শুনানি হয়।
গত ২৯ মার্চ রাতে রাজধানীর রমনা থানায় মামলাটি করেন আবদুল মশিউর মালেক নামে এক আইনজীবী। মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, পত্রিকাটির নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরাম্যান ও অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায়ও ২৯ মার্চ রাতে সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামে এক যুবলীগনেতা বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা করেন। তবে এ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।
প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনের কিছু উদ্ধৃতি নিয়ে একটি গ্রাফিক্যাল ‘কার্ড’ তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়। ওই কার্ডে একটি শিশুকে ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাকির হোসেন নামে একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কার্ডে লেখা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম? বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’
এই বক্তব্য নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে একাত্তর টিভির একটি প্রতিবেদনে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি উদ্দেশপ্রণোদিত ও সাজানো বলে দাবি করা হয়। শিশুটির বরাতে বলা হয়, ‘প্রথম আলোর সাংবাদিক তার হাতে ১০ টাকা দিয়ে এ ছবি তুলেছেন।’
প্রথম আলো দাবি করে, ‘পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় ছবি এবং উদ্ধৃতির মধ্যে অসঙ্গতির বিষয়টি তাদের নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে কার্ডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সংশোধনও করা হয়। এরপর সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখ করে পরে তা আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। তারা দাবি করে, প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি ওই উদ্ধৃতিটি ওই শিশুর। তারা উল্লেখ করে, প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।’
এ ঘটনায় ৩০ মার্চ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘স্বাধীনতার দিনটি আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি। সেই দিন তথ্যভিত্তিক নয়—এমন সংবাদ প্রকাশ করে একটি পত্রিকা। যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়েছে, সেটাকে কটূক্তি করে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেজন্য পুলিশের একটি দল সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিলেও এ ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে, কয়েকটি মামলা ইতোমধ্যে হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়েছে, সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে নয়।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ২৬ মার্চ প্রথম আলোর অনলাইনে যে সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে, এটি অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, সেখানে একটা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে তাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সে যেটি বলেনি, সেটি প্রচার করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি বলেই তো তারা (নিউজ) সরিয়ে নিয়েছে। এখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে।’
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছেলের নাম সবুজ। তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন। ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর।’