বিএনপিকে মোকাবিলায় তৎপর ছিল আ.লীগ, নতুন নেতৃত্বে পুরোনো মুখ
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিচ্ছে ২০২২ সাল। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খোশ মেজাজে ছিল বর্তমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয় বার ক্ষমতায় থাকা দলটির অন্যতম অর্জন। দেশের দুটি মেগাপ্রকল্প উদ্বোধন, নিজেদের জাতীয় সম্মেলন করে শেখ হাসিনাকে পুনরায় দলীয় সভাপতি করাসহ বিরোধীদলগুলোকে কোনোপ্রকার বড় অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া মোকাবিলা করা এবং স্থানীয় নির্বাচনেও সফলতা দেখিয়েছে দলটি।
বছরের শুরুতে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও শেষ সময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে দলটির নেতাকর্মীদের। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন করেছে দলটি। সমানতালে চলছে প্রচার-প্রচারণাও। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর দীর্ঘদিন সভা-সমাবেশ এড়িয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে, বছরের শেষ দিকে এসে কয়েকটি বিভাগীয় শহরে জনসমাবেশে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে যশোর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মহাসমাবেশে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের সম্মেলন এবং যুবলীগের সমাবেশে অংশ নেন।
গত ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ছিল উত্তেজনা। সেদিন ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে শুরু থেকেই চলছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বাহাস। শুরুতে সরকার বিএনপিকে সমাবেশের জন্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়। কিন্তু সেখানে সমাবেশ করতে রাজি হয়নি বিএনপি। তারা (বিএনপি) নয়াপল্টনের রাস্তায় সমাবেশ করতে চেয়েছিল। সমাবেশের চার দিন আগেই বিএনপির নয়াপল্টন অফিসে সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এরপর সরকারের কাছে নতুন স্থানের আবেদন করে বিএনপি। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গোলাপবাগ মাঠে অনুমতি পায় দলটি। সেখানেই ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দেন। তার এমন নির্দেশনার পর রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন।
২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। বিএনপির এ সমাবেশ শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপ কালে আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটি আওয়ামী লীগের জয় আর বিএনপির পরাজয়।
দশমবারের মতো দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা, হ্যাটট্রিক ওবায়দুল কাদেরের
বছরের শেষ দিকে গত ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও টানা তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের। সভাপতি হিসেবে সবাই শেখ হাসিনার বিষয়টি নিশ্চিত থাকলেও সাধারণ সম্পাদক নিয়ে সবার মধ্যে কিছুটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়। তবে শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ওবায়দুল কাদেরের ওপর আস্থা রাখেন।
গত ১৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় যুব মহিলা লীগের সম্মেলন। সম্মেলনে প্রায় দুই দশক পর নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে যুব মহিলা লীগের। যুব মহিলা লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন আলেয়া সারওয়ার ডেইজি এবং সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় গত ২৬ নভেম্বর। সম্মেলনে নতুন সভাপতি হন মেহের আফরোজ চুমকি এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন শবনম জাহান শিলা। এরপর গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে কমিটি ঘোষণা না করে কাউন্সিলররা দায়িত্ব দেন সাংগঠনিক অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার অনুমতি নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ পর হত ২০ ডিসেম্বর গণভবন থেকে বের হয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কমিটিতে সাদ্দাম হোসেনকে সভাপতি ও শেখ ওয়ালি ইয়াসির ইনানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিও ঘোষণা করা হয় একই সময়ে।
দলীয় প্রধানের তিন মহাসমাবেশ
করোনা মহামারির কারণে গণভবন থেকেই রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ সেরেছেন প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। তবে বছরের শেষ দিকে গত ২৪ নভেম্বর যশোর, ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে মহাসমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। ওই তিন মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি মহাসমাবেশে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নেন। করোনা-পরবর্তী সময়ে যশোরে জনসভার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু হয়। প্রতিটি জনসভা জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে বলে দাবি করেনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বিএনপিকে শক্তহাতে মোকাবিলা
দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির বছরের প্রথম দশ মাসে বড় কোনো সভা-সমাবেশ না থাকায় তেমন বেগ পেতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। তবে নভেম্বরে বিভাগীয় শহরগুলোতে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নড়েচরে বসে আওয়ামী লীগ। বিএনপি থেকে ঘোষণা আসে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে জাতীয় সরকার গঠন করবেন তারা। এরপর সরকার প্রধান করা হুঁশিয়ারি দিয়ে বিএনপিকে আর কোনো ছাড় নয়। তাদের সমাবেশকে ঘিরে পাড়া-মহল্লায় জনগণের জানমাল রক্ষার্থে পাহারা দেওয়া নির্দেশ দেন। নেতাকর্মীরাও অবস্থান নেন। এরপর ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা গণমিছিলের ডাক দেয়। তখনো আওয়ামী লীগ থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। বড় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই তা শেষ হয়।
স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহীদের দাপট
চলতি বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বিদ্রোহীদের দাপট! এ নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির অন্যতম কারণ ছিল বিদ্রোহীদের দাপট আর তৃণমূলের পাঠানো তালিকায় অনিয়ম। সবমিলিয়ে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছর। সেই নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় ছিল আওয়ামী লীগ।
জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা ভোটে বিজয়ীদের নিয়ে অস্বস্তি
চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর সারা দেশে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন আদালত কর্তৃক স্থগিত করা হয়। ভোলা ও ফেনী জেলার সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রার্থীরা। ২৬ জেলায় চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে ১৮ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
তৃণমূলের সম্মেলন
করোনার কারণে গত দুই বছর জেলা, উপজেলা কিংবা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন, বর্ধিত সভা ও যৌথ সভা করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। চলতি বছর ঢাকা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, বরগুনা, কুমিল্লা মহানগর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, কুমিল্লা দক্ষিণ, জামালপুর, নোয়াখালী, কক্সবাজার, মাগুরা, নওগাঁ, নাটোর, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া শতাধিক উপজেলা ও বেশ কয়েকটি মহানগরের সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। তৃণমূলের এসব সম্মেলন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।