ভুল চিকিৎসায় ছাত্রমৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতাল ঘেরাও, আর্থিক সহায়তার আশ্বাস
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে সাগর খান (১৮) নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ভুল চিকিৎসা ও অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রায় দুই ঘণ্টা হাসপাতাল ঘেরাও করেছে এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ছাড়াও নিহত সাগরের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সদরের পৌর এলাকার জয়নগর গ্রামের ডা. জোসেফ মেমোরিয়াল হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে।
সাগর খান চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সম্প্রতি কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। তিনি পৌর এলাকার জয়নগর গ্রামের হারুন খানের ছেলে।
হারুন খানের অভিযোগ, তাঁর ছেলে কয়েকদিন ধরে পেট ব্যথায় ভুগছিলেন। পরে গত শনিবার স্থানীয় ডা. জোসেফ মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানে ভর্তির পর কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা রয়েছে এবং অপারেশন করতে হবে। সে অনুযায়ী ওইদিন সন্ধ্যায় অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়া হয় সাগরকে। পরে অ্যানেস্থেসিয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, অপারেশন করতে গিয়ে তাঁরা কালো জমাট বাঁধা রক্ত দেখেছেন। তখনই অপারেশন বন্ধ করে দেন চিকিৎসকেরা। পরে তাঁরা বলেন, ‘আপনার ছেলের রক্ত খারাপ। এখানে অপারেশন হবে না। তাঁকে সাভারে নিতে হবে।’ পরে অভিভাবকদের না জানিয়ে সাভারের সুপার মেডিকেল হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় সাগরকে।
হারুন খান আরও অভিযোগ করেন, সুপার মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানকার কর্তৃপক্ষ রোগীকে ভর্তি করে এবং দুধ, ওষুধ ছাড়াও যখন যা দরকার তাই দেয়। এক পর্যায়ে স্বজনেরা চিকিৎসককে যখন বলেন, আপনারা রোগীকে যাই খাওয়ান না কেন, আমাদের সামনে খাওয়ান। এরপর গত রোববার রাতে স্বজনেরা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ঢুকলে হাসপাতালের লোকজন সাগরকে শয্যা থেকে নিচে নামিয়ে দেন এবং জানান, রোগী মারা গেছেন।
এদিকে, নিহত সাগরের প্রতিবেশী বিমল চন্দ্র রাজবংশীর দাবি, নয়টি টেস্ট করানোর পর চিকিৎসকেরা জানান, রোগীর অপারেশন করতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে ওটিতে নেওয়া হয়। তখন সাগরের বন্ধুরাসহ এলাকার অনেক লোকজন বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। অনেক্ষণ হয়ে যাওয়ার পর যখন দেখা যায়, রোগীকে আর বের করা হচ্ছে না, তখন সবাই জানতে চান—রোগীর কী হয়েছে? পরে এলাকাবাসীর হট্টগোলে চিকিৎসকেরা বের হন এবং জানান, রোগীর রক্ত কালো হয়ে গেছে, তাঁকে এখানে অপারেশন করানো সম্ভব না। পরে সাভারের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘এতোদূরে রোগীকে এনেছেন কেন? আপনাদের কাছে কি কোনো ভালো হাসপাতাল ছিল না?’ তাঁদের ভাষ্যমতে, রোগী ডা. জোসেফ মেমোরিয়াল হাসপাতালেই মারা গেছেন।
এদিকে, সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় সাগরের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছেন স্বজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, দায় থেকে রক্ষা পেতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাগরকে সাভারের হাসপাতালে স্থানান্তর করে।
চিকিৎসকের অবহেলা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনিয়মের অভিযোগ এনে গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত জয়নগর এলাকায় ওই হাসপাতাল ঘেরাও করেন সাগরের বিক্ষুব্ধ স্বজন, সহপাঠী ও এলাকাবাসী। এক পর্যায়ে হাসপাতাল ভাঙচুরের চেষ্টাও চালানো হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে এবং তাদের অনুরোধে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।
ডা. জোসেফ মেমোরিয়াল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের সার্জন ও অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। অস্ত্রোপচারের সময় সাধারণত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ডেকে আনা হয়। সে সময় সাগরের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের সার্জন ডা. আরিফুর রহমান এবং শিক্ষানবিশ অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক আবদুল মোমেন। মোমেন রংপুরের বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাশ করেছেন।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের সার্জন ডা. আরিফুর রহমানের দাবি, রোগীর স্বাস্থ্যগত সব পরীক্ষা রিপোর্ট ভালো ছিল। অচেতন করার পর রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। ওই পরিস্থিতির জন্য রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়নি।
এদিকে, ডা. জোসেফ মেমোরিয়াল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিল উদ্দিন বলেন, ‘স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি মিমাংসা হয়েছে। ওই ছাত্রের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মানিকগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীর চিকিৎসার সব কাগজপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’