ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা ভারতফেরত তরুণীর, ১ হাজার নারীকে পাচার করেন বাবু
টিকটকে পরিচয়ের সূত্র ধরে লোভনীয় চাকরির কথা বলে এক তরুণীকে ভারতে পাচার করে দেয় একটি পাচারকারী চক্র। ভারতের বেঙ্গালুরুতে ৭৭ দিন আটক থাকা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনসহ বিকৃত যৌনাচারের শিকার হন তরুণী। পরে তিনি কৌশলে পালিয়ে এসে পুলিশের কাছে বর্ণনা দিয়েছেন ভযংকর এসব নির্যাতনের তথ্য।
নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় মোট ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ আজ বুধবার নিজ কার্যালয়ে এসব তথ্য জানান।
মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘মামলার আসামি ১২ জনের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যতম হোতা টিকটক হৃদয় এবং গ্রেপ্তার করা তিনজন একই চক্রের সদস্য। বাকি কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক বলে জানা গেছে।’
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা হলেন—মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের, যাঁরা ভারতে প্রায় এক হাজার নারীকে পাচারে সীমান্ত পার হতে সরাসরি সহায়তা করেছেন। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে থেকে পাচারের কাজে ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মোবাইল এবং একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
এক হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার
মো. শহিদুল্লা বলেন, ‘গ্রেপ্তার করা মেহেদী হাসান বাবু পাচারের শিকার হওয়া তরুণীসহ এক হাজারের বেশি নারী পাচারে জড়িত ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। সাত-আট বছর ধরে পাচারে জড়িত মেহেদী হাসান বাবুর মোবাইল ও ডায়েরিতে টিকটক হৃদয়, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। তাঁর ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ভিকটিমের তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ভারতে পাচার হওয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম এবং মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।’
‘অপর গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদ্বয়—মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত কক্ষে ভিকটিমদের অবস্থানে সহায়তার পাশাপাশি তাদের মোটরসাইকেলে করে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন’, যোগ করেন ডিসি।
টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয়
মো. শহিদুল্লা আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ভুক্তভোগী ওই তরুণীর। কখনও টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, কখনও ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে ‘টিকটক হ্যাংআউট’ করেন হৃদয়। পরে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করা হয়। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই তরুণীকে চক্রের অন্যান্যদের সহায়তায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেন হৃদয়।’
যেভাবে ৭৭ দিন নির্যাতন করা হয়েছিল তরুণীকে
মামলার পর ওই তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, ভারতে পাচারের পর তাঁকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। যাদের সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পরই ওই ভুক্তভোগী তরুণীকে চেন্নাইয়ের অয়ো হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন করা হয় তাকে। সেখানে সামান্যতম দয়া কিংবা করুণা দেখায়নি চক্রের সদস্যেরা।’
‘কৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য বা পরিচিতদের পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল এই ভুক্তভোগী তরুণীকে। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা ওই কিশোরীর করা মামলার এজাহারে ও তদন্তে উঠে এসেছে লোমহর্ষক বর্ণনা, যার করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে’, যোগ করেন ডিসি মো. শহিদুল্লাহ।
মো. শহিদুল্লাহ আরও বলেন, ‘ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্যাতিত ওই তরুণীর সহায়তায় ভারতে পাচার হওয়া তিনজন দেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। যাঁদের একজন ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর দেশে ফিরেছেন। তিনিই হাতিরঝিল থানায় মামলাটি করেন। বাকি দুজন ভারতফেরত ভুক্তভোগীর নাম-ঠিকানা জেনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে পুলিশ।’