‘মৃত্যুর মুখেও বন্ধুরা একসাথে ছিলাম, মনোবল হারাইনি’
‘মৃত্যুর মুখেও আমরা বন্ধুরা সবাই একসাথে ছিলাম, কেউ কাউকে ছেড়ে যাইনি। ২১ জন এক সাথে গিয়েছিলাম আবার এক সাথেই ফিরে আসতে পেরেছি, এজন্য আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া। পানির অপর নাম যেমন জীবন তেমনি মরণ, এই কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি৷ আমাদের মধ্যে ২-৩ জন ছাড়া ভালো সাঁতার কেউ জানতাম না৷ আর সাঁতার জানলেও ওই স্রোতে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। ১৮ তারিখ রাতের পর যে কটা দিন জীবনে পাব সেটা আসলে বোনাস হিসেবে বেঁচে থাকা। মৃত্যুর মুখে আব্বু আম্মুর মুখটা সামনে খুব ভাসছিল। তাদের কথা কানে আসছিল আমাদের সম্পদ একটাই, একে হারাতে চাই না। তাদের খাওয়া-ঘুম সব শেষ। শুধু দোয়া করেই গেছেন, যেন সন্তানটা বেঁচে ফিরে।’ ঠিক এমনটাই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার প্রাপ্তি।
প্রাপ্তি তার আরও বিশজন বন্ধু-বান্ধবের সাথে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সময় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
গত ১৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সুনামগঞ্জ ভ্রমণে গিয়ে বন্যায় আটকা পড়েন লামিয়া আক্তার প্রাপ্তিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরও ২১ শিক্ষার্থী। পরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাদেরকে পানসী রেস্তোরাঁ থেকে উদ্ধার করে গত শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলে জেলা পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। এরপর শনিবার (১৮ জুন) ওই ২১ শিক্ষার্থীসহ প্রায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি লঞ্চ সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর চরে আটকা পড়ে। বহু প্রচেষ্টার পর সেটি রাত আড়াইটার দিকে তীরে পৌঁছায়। রোববার সকাল পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করেন। সকাল আটটার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে ঐদিনই ঢাকায় পাঠায়।
উদ্ধারকৃত ওই ২১ শিক্ষার্থীর একজন হোসাইন আজমল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা একেবারেই অকথ্য, অকল্পনীয়, অভাবিত আবেগের মিশ্রণ। ভয়ঙ্কর তিনদিন পর বেঁচে থাকতে পেরে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাড়ি ফিরতে পেরে আমি খুশি। দুর্যোগের পুরোটা সময় আমরা নিজেরাই একে অপরের প্রথম অবলম্বন ছিলাম। যখনই কেউ ঘাবড়ে গিয়েছে, আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছে আমরা তাকে মানসিক শক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের বিভাগের চেয়ারপার্সন স্যার, শিক্ষকগণ, সিনিয়র ভাইয়েরা অনবরত আমাদের সাথে কথা বলে গেছেন ও ইমারজেন্সি সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। এটি আমাদের মনোবল দৃঢ় রাখতে সহায়তা করেছে।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাহসিন নাওয়ার প্রাচী বলেন, ‘বন্যাদুর্গত এলাকায় চলার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। তারপর আবার সুনামগঞ্জ যাওয়ার পর যে পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে, তা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমরা এই বন্যার পানি অতিক্রম করেছি বারবার। ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ, একদিকে প্রচণ্ড ঢেউ অপরদিকে বারবার স্রোত অতিক্রম করা। আমি যতদূর জানি, বন্যার পানিতে স্রোত হয় না, তবে আমরা চলার পথে এরকম অনেক জায়গা পেয়েছি, যেখানে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সুনামগঞ্জ থেকে যখন সিলেটের দিকে রওনা দেই, তখন আমাদের জন্য ছোট্ট একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চ ধারণক্ষমতার তুলনায় দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে যখন সুনামগঞ্জ সুরমা নদীর চরে আটকে যায়। সেই সময়ে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। সন্ধ্যা রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত অন্ধকারে নদীর চরে আটকে থাকা অবস্থায় যেকোনো সময় ধরে নৌকাটা উল্টে যেতে পারতো বা তলিয়ে যেতে পারত। এই সময়টা খুব খারাপ গিয়েছে। এর আগে ট্রলারে করে যখন সুনামগঞ্জ যাচ্ছিলাম, যাওয়ার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি ও বজ্রপাত, মাঝির নৌকা পথ হারিয়ে ফেলা, ঘাটে পৌছাতে না পারা, অবিরত বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা বাতাস ও পানির ঢেউয়ের মাঝেই মাঝনদীতে দিশেহারা হয়ে ঘুরার ব্যাপারটা অনেক কষ্টদায়ক ছিল।’
প্রাচী আরও বলেন, ‘কয়েকদিনের ওই ঘটনাগুলোয় ভয়ও কাজ করেছে। আবার আমাদের গ্রুপটা বড় হওয়ার কারণে বন্ধুরা সবসময় একজন আরেকজনের পাশে ছিলাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিতে সবার কন্ট্রিবিউশন থাকায় ভয় জিনিসটা সহজেই কেটে গেছে। ওরকমভাবে কেউ প্যানিকড হয়ে যায়নি, যতটুকু হয়েছে তা অল্প সময়ের মধ্যেই সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা সবাই মিলে। আরেকটি খারাপ অভিজ্ঞতা হল ওখানে কোনো নেটওয়ার্ক ছিল না। এত জনের ভিতর কয়েকটা ফোনে হঠাৎ করে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিল। দুই-একজনের ফোনে হঠাৎ নেটওয়ার্ক আসার কারণে মাঝে মাঝে বাইরে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছি, নয় আমাদের খোঁজ থাকত না।'
শোয়াইব আহমেদ নামে একজন বলেন, ‘কত বড় বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আমরা গত রাত (১৯ জুন) রাত সাড়ে ১২টায় সিলেট থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে পেরেছি। আমরা সবাই (২১ জন) সুস্থভাবে এসেছি এটাই অনেক অনেক শুকরিয়া। আমরা যে সবার সাথে আবার দেখা করতে পারব, সেটা কখনোই ভাবতে পারিনি। সবার সাথে দেখা হলো, কথা হলো এটা ভেবেই আনন্দে কান্না পাচ্ছে বারবার।’
শোয়াইব আরও বলেন, ‘আমরা ভালোভাবে ফিরে আসছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আমাদের কাছে কিছু ছিল না। আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা এই কয়েকদিনে নিয়েছি। এরপরও সবচেয়ে ভালোলাগার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা আপনাদের মাঝে ফিরে আসতে পারছি। আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুক। কাউকে যেন আমাদের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়।’