মোটরসাইকেল কিনতে শিশুকে অপহরণ করে হত্যা!
আধিপত্য বিস্তারের জন্য স্থানীয় ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে আসতে হবে। সেজন্য মোটরসাইকেল থাকা জরুরি বলে ধারণা হয় এক কিশোর ও তাঁর দুই সিনিয়র বন্ধুর। সেই টাকা সংগ্রহের জন্যই তিনজন মিলে এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু শিশুটিকে হত্যা করলেও মুক্তিপণ আর আদায় হয়নি। তিনজনকেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঘটনাটি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার। নিহত শিশুর নাম আল-আমিন (৭)। সে উপজেলার বেরুন্ডি গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। আর গ্রেপ্তারদের মধ্যে একজন ১৬ বছরের কিশোর। অপর দুজন হলেন হৃদয় হোসেন (২০) ও সাদ্দাম হোসেন (১৯)।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডির পিবিআইয়ের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মানিকগঞ্জ ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর আলম।
এম কে এইচ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে শিশু আল-আমিন বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তার ওপর বাইসাইকেল চালানোর জন্য বের হয়। বের হওয়ার পর এক ঘণ্টা পার হলেও বাড়ি না ফিরছিল না শিশুটি। ফলে তার মা খোঁজাখুজি শুরু করেন। ছেলেকে না পেয়ে পরদিন ২৯ আগস্ট আল-আমিনের বাবা শহিদুল ইসলাম সিংগাইর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।’
‘পরে ৩১ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা আল-আমিনের সন্ধানে বেরুন্ডি গ্রামের চকে টেমা মিয়ার পরিত্যক্ত ভিটায় খোঁজ করে। সেখানে বাঁশঝাড়ের ভেতর শিশুটির পরনের গেঞ্জির অংশবিশেষ, প্যান্ট ও মাছির আনাগোনা দেখতে পায়। সন্দেহজনক অবস্থায় সেখানে গিয়ে বাঁশপাতা সরিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় সাদা রংয়ের একটি প্লাস্টিকের বস্তা দেখতে পান তারা। পরে সেটির ভেতর মেলে শিশু আল-আমিনের নিথর দেহ’, যোগ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিশু আল-আমিন হত্যার বিষয়ে ওইদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তা আমাদের নজরে আসে। এরপরই আমরা ছায়াতদন্ত শুরু করি এবং ঘটনার সম্ভাব্য সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। সেই সঙ্গে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও শিশু আল-আমিনের সেদিনের চলাফেরার সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে হৃদয়, সাদ্দাম ও আরেক কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে। সকালে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
‘জিজ্ঞাসাবাদে তিন তরুণ জানিয়েছে, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য যে কাউকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করে তারা। এজন্য তারা প্রথমে এলাকার বাসিন্দা দুজনের কথা চিন্তা করে। কিন্তু একজনরে বয়স বেশি হওয়ায় তাকে বাদ দেয়। পরে আল-আমিনকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘মুক্তিপণ আদায়ের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হৃদয় শিশু আল-আমিনকে বন্যার পানি দেখানোর কথা বলে সাপের ভিটায় (বড় বাঁশঝাড়) নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল কিশোর। দুজনে মিলে প্রথমে আল-আমিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে কিশোরের কাছে থাকা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে মৃতদেহ ঢুকিয়ে ফেলে। আল-আমিনের পরণের গেঞ্জি ও প্যান্ট মুক্তিপণ আদায়ের প্রমাণ হিসেবে খুলে রাখে। এরপর লাশের বস্তাটি বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি জায়গায় প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবিয়ে রেখে একটি মুরগির নিটারের (বর্জ্য) বস্তা দিয়ে চাপা দেয়। এ সময় কিশোরের ফোন থেকে হৃদয়, সাদ্দামকে ফোন দিয়ে বলে যে কাজ হয়ে গেছে।’
‘ঘটনার পরে আল-আমিনের ব্যবহৃত সাইকেল লুকিয়ে রাখে এবং রাতে হৃদয়দের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরে ফেলে দেয়। তারা ২৮ আগস্ট আল-আমিনকে হত্যা করলেও হৃদয় যে জায়গায় বস্তা পুঁতে রেখেছিলো সেই বস্তা পানির নিচ থেকে তুলে পাশেই শুকনো জায়গায় মাটিতে গর্ত করে ৩০ আগস্ট আবারও পুঁতে রাখে। যে কারণে স্থানীয়রা ওইদিন মৃতদেহটা খুঁজে পায়।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তাদের পরিকল্পনা ছিলো শিশুটিকে হত্যার পর নতুন সিম থেকে শিশুর স্বজনদের ফোন দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবে। কিন্তু সাদ্দাম ঘটনার দিন নতুন সিম সংগ্রহ করতে না পারার কারণে আল-আমিনের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই তারা মুক্তিপণও চাইতে পারেনি। কিন্তু মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই স্থানীয়রা শিশুটির মৃতদেহ পেয়ে যাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।’
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তারা পালানোর জন্য প্রথমে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের একটি হোটেলে উঠে। সেখানে হোটেল বয়ের ফোন থেকে ওই শিশুর বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় হৃদয়। কিন্তু তারা যেকোনো সময় ধরা পরার ভয়ে ছিল। তাই মুক্তিপণ চাইলেও ওইদিন সাভার থেকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে চলে যায়। তারা অবৈধভাবে ভারতে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি এড়াতে পারেনি তারা। এ ছাড়া অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা দিতে না থাকায় পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরে সেখান থেকে রাজবাড়ীতে পালিয়ে যায় তারা। সেখানে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে পিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে।’
এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত এসপি বলেন, ‘তারা আগে থেকেই অপহরণের পর হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। মূলত, তাদের অপহরণের পর অপহৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পালানোর মতো সক্ষমতা ছিলো না। অপহৃত ব্যক্তিকে রাখতে হলে টাকা প্রয়োজন, গাড়ি প্রয়োজন, সেসব না থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যাকেই অপহরণ করবে আগে হত্যা করবে। তারপর হত্যার শিকার ব্যক্তির পোশাক স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে টাকা আদায় করবে। এটাই ছিলো তাদের মোটিভ।’