শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর জট খোলেনি, নমুনা যাচ্ছে ঢাকায়
গাজীপুরে প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে শিক্ষক দম্পতির লাশ উদ্ধার ঘটনার রহস্য এখনও উদঘাটন করতে না পারায় তাদের মৃত্যুর জট খোলেনি। তবে তাদের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে জব্দকৃত ও সংগৃহীত আলামত এবং তাদের ভিসেরাসহ নমুনা পরীক্ষার জন্য আজ রোববার ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে।
গতকাল শনিবার গাজীপুরের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে শিক্ষক দম্পতিকে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) গাছা জোনের সহকারী কমিশনার মাকসুদ উর রহমান জানান, শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে। প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে শিক্ষক দম্পতির লাশ উদ্ধারের ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্ন আলামত জব্দ করে। তাদের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে ওইসব জব্দকৃত আলামত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষার অনুমতির জন্য গতকাল গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করা হয়। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ওই আবেদন অনুমোদন করেছেন।
মাকসুদ উর রহমান আরও জানান, আদালতের অনুমতির পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষক দম্পতির মৃত্যু খাদ্যে বিষক্রিয়া বা অন্য কোনো কারণে হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে চেষ্টা চলছে। তাদের গাড়ি থেকে জব্দকৃত টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, পানির বোতলে থাকা পানি, জর্দার কৌটা, ছেলের জন্য কেনা ফাস্টফুডের প্যাকেটে থাকা পাস্তাতে বিষ বা অ্যালকোহলের উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য নমুনা ঢাকায় মহাখালীর প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষকের কার্যালয়ে এবং সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া জব্দকৃত তাদের ব্যবহৃত প্রাইভেটকার পরীক্ষার জন্য ঢাকার বিআরটিএতে নেওয়া হবে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা হবে ঘটনার সময় গাড়িতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কি না বা গ্যাস লিক হয়েছে কি না, যে কারণে তাদের মৃত্যু হতে পারে।
মাকসুদ উর রহমান বলেন, নিহতদের দেহ থেকে সংগৃহীত ভিসেরা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এ পরীক্ষা থেকে জানা যাবে তারা কী খেয়ে ছিলেন এবং খাবারে বিষাক্ত কিছু ছিল কি না—যা ওই দম্পতির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নিহতদের দেহ থেকে সংগৃহীত বাক্কাল সোয়াব ঢাকায় চিফ ডিএনএ এনালিস্টের কাছে পাঠানো হবে।
জিএমপির গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নন্দলাল চৌধুরী জানান, আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে এসব আলামত পরীক্ষার জন্য আজ ঢাকায় নেওয়া হবে। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এসব আলামত শনিবার ঢাকায় পাঠানো হয়নি। এসব আলামত পরীক্ষার পর শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে রিপোর্ট পেতে একটু সময় লাগবে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি।
ওসি আরও জানান, শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশের জোর তদন্ত চলছে। তদন্তের পাশাপাশি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি নজরদারি করছেন ও ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
এদিকে মামলার বাদী আতিকুর রহমান (নিহত শিক্ষক এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুনের মেজো ভাই) বলেন, মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তারা প্রতিটি বিষয়কে খতিয়ে দেখছে। মৃত্যুর একাধিক কারণের মধ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টিকে তারা বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার বাদী আরও বলেন, আমাদের পরিবার এখনও এ শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। খুব শিগগিরই তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে গাজীপুরে ও গ্রামের বাড়িতে দোয়ার আয়োজন করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার (১৭ আগস্ট) বিকেলে বিদ্যালয়ের কাজ শেষে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারযোগে গাজীপুর মহানগরীর কামারজুরী এলাকার বাসায় ফিরছিলেন টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুন (৫১) ও তার স্ত্রী আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫)। পথে তারা নিখোঁজ হন। দীর্ঘ সময় বাসায় না ফেরায় স্বজনরা বিভিন্নস্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে পরের দিন বৃহস্পতিবার ভোরে বাড়ির কাছে গাছা থানাধীন বড়বাড়ির বগারটেক এলাকায় হারবাইদ-বড়বাড়ি সড়কের পাশে থেমে থাকা প্রাইভেটকার থেকে ওই দম্পতির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল, নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে লাশ উদ্ধারের সময় তাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষক জিয়াউর রহমানের মেজো ভাই কামারজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গাছা থানায় একটি মামলা করেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ
এদিকে শিক্ষক দম্পতির লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শনিবার টঙ্গীতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ শুরু করেছে।
জানা গেছে, গত বুধবার স্কুলের কাজ শেষে শিক্ষক দম্পতি বাড়ি ফিরেননি। পরের দিন বৃহস্পতিবার ভোরে বাড়ির অদূরে নিজস্ব গাড়ি থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় উভয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাসহ স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। নিহতদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষক দম্পতিকে হত্যার ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টঙ্গীতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় জিএমপির সহকারী উপকমিশনার (এডিসি) হাসিবুল আলম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দেন। তার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভকারীরা তাদের আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গতকাল ময়মনসিংহের ত্রিশালের গ্রামের বাড়িতে তাদের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে, ওই ঘটনায় শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় জিএমপির গাছা থানায় নিহত প্রধান শিক্ষকের বড় ভাই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন।