২০২২ সালে প্রশাসনের আলোচিত ঘটনা
বিদায়ী বছরে দেশের প্রশাসনে বেশ কয়েকটি ঘটনা ছিল আলোচিত। এর মধ্যে একজন সচিবসহ কয়েক কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক অবসর নিয়ে ছিল আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও। এ ছাড়া পদোন্নতি ও বদলির ঘটনাও ছিল ব্যাপক। আলোচনায় বাদ যায়নি ডলার সংকট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে আসায় সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও নির্দেশনাও। এদিকে, সরকারি প্রকল্পের জন্য বই কেনার তালিকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামেরই ২৯টি বই স্থান কীভাবে পায়, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রশাসনেও হয় তোলপাড়।
সচিবের বাধ্যতামূলক অবসর আলোচনার শীর্ষে
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনের। গত ১৬ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে আকস্মিকভাবেই সচিব মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানোর কথা জানানো হয়। যখন এ খবর তথ্য মন্ত্রণালয়ে যায়, ওই সময় মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় ছিলেন মকবুল হোসেন। তথ্যসচিবের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা সেই সভায় গিয়ে তাঁকে নিজের কক্ষে ডেকে এনে খবরটি জানান।
মকবুল হোসেনের বাধ্যতামূলক এ অবসর প্রশাসনজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার বছরখানেক আগে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে এভাবে বিদায় দেওয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন ওঠে। পরদিন তিনি নিজেও তাঁর দপ্তর থেকে বিদায় নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে সময় তিনি বলেন, ‘আমি যতদিন এখানে কাজ করেছি, সততার সঙ্গে করেছি। আমার জানা নেই বা জ্ঞানের ভেতরে নেই, আমার কোনো অপরাধ ছিল কিনা বা কোনো অপরাধের কারণে অবসরে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার এটি পারে, আইনের মধ্যেই পারে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী, জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে সচিব মকবুল হোসেনকে অবসর প্রদান করা হলো।
সরকারবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ অস্বীকার করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করতে পারেন যে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তথ্যসচিবের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে, তাহলে সেটি আপনারা প্রচারও করতে পারেন। আমার পক্ষ থেকে কোনো অসুবিধা নেই।’
মকবুল হোসেন জানান, ‘তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর বয়স যখন ৯ বছর, তখন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর নিজের বাড়িতে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁর ভাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। বাকি জীবনেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে চলবেন তিনি।’
পুলিশ কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর
গত ১৬ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মো. আলী হোসেন ফকিরকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এরপর গত ১৮ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। এরপর ৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তারা হলেন—ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম।
গত ২১ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় এসপি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানকে। এরপর ৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তারা হলেন—ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম।
সর্বশেষ ২০শে ডিসেম্বর অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মুনির হোসেনকে অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
২৩ জেলার ডিসি পদে রদবদল
গত ২৩ নভেম্বর মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন করা হয়। ওইদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৩ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, খুলনা, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, জয়পুরহাট ও মাগুরায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রশাসনের শীর্ষ পদে পরিবর্তন
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব পদের পরিবর্তনও ছিল বছরের শেষ দিকের আলোচনায়। গত ১১ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ পান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার। গত ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। এর আগে গত ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নতুন মুখ্যসচিব নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।
একইদিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ঢাকায়
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মমিনুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় কামনা করে দলীয় নেতাদের সঙ্গে মোনাজাতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে আবারও ক্ষমতায় আসেন, সেজন্য সবার কাছে দোয়া চান তিনি। পরে তিনি প্রার্থীকে পাশে বসিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এমনই একটি বিষয় নিয়ে বেশ কয়েক মাস চলেছে আলোচনা-সমালোচনা।
তবে, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান ওই সময় সাংবাদিকদের নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে সম্প্রীতি সভায় আমি বক্তব্য দিয়েছি। দুর্গাপূজা যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় তাই জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের দায়িত্ব নিতে বলেছি। কিন্তু এটা নিয়ে ভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে। আর কিছু বলতে চাই না। তার বক্তব্যটি প্রশাসনে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। তারপর তাকে ঢাকা জেলা প্রশাসক পদে বদলি করা হয়।
এক অতিরিক্ত সচিবেরই ২৯টি বই
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়াতে লাইব্রেরির জন্য বই কেনার তালিকায় একজন অতিরিক্ত সচিবের ২৯টি বই স্থান পাওয়ার বিষয়টি চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাসের জন্য এক হাজার ৪৭৭টি বইয়ের তালিকা করা হয়। সেই তালিকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামেরই ২৯টি বই স্থান পেয়েছিল।
সমালোচনার মুখে গত ২৯ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওই তালিকা বাতিলের কথা জানানো হয়।