কারারক্ষী হত্যায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা (পিআরএল) এক সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর সোমবার কারা ফটকের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় নিহতের জামাতা সোহেল রানাকে (৩৫) আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে ফার্মেসির মালিক সাইফুল ইসলাম ও পথচারী রফিককে থানায় নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহতের নাম রুস্তম আলী হাওলাদার (৫৯)। তিনি কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালি থানার দক্ষিণ চরতা গ্রামের আব্দুল মান্নান হাওলাদারের ছেলে। রুস্তমের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার চড়গাছিয়া এলাকায়।
কোনাবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মোবারক হোসেন জানান, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ি নতুন বাজার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার লিঙ্ক রোডে কারাগারের ফটক থেকে মাত্র ২৫০ গজ দূরে ডেঙ্গা মার্কেটের আহমদ মেডিকেল কর্নার নামের একটি ঔষধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঔষধ কিনছিলেন রুস্তম। এ সময় তিন যুবক একটি মোটরসাইকেলে চড়ে সেখানে আসে। মোটরসাইকেল আরোহীদের মধ্যে এক যুবক মোটরসাইকেল থেকে নেমে ওই দোকানে এগিয়ে যায় এবং রুস্তমকে লক্ষ্য করে পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রুস্তম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় কাশিমপুর কারাগার কর্তৃপক্ষ গুলিবিদ্ধ রুস্তমকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে দুই রাউন্ড গুলির খোঁসা উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহত রুস্তমের স্ত্রী নাসরিন আক্তার ও ছোট ভাই শাহ্ আলম বলেন, ‘রুস্তম আলী কারাগারের আবাসিক এলাকায়ই সপরিবারে থাকেন। কারাগারের পাশে দেউলিয়া বাড়ি এলাকায় জমি কিনে সেখানে বাড়ি করেছেন। সেই বাড়িটি ভাড়া দেওয়া। ঘটনার আগে সকালে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কারা ফটকের সামনে কেনাকাটা করেন। পরে তিনি স্ত্রীকে বাসায় রেখে পুনরায় কারা ফটকের সামনে ফিরে এলে হামলার ঘটনা ঘটে।’
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ভাঙ্গারি দোকানের মালিক স্বপন মিয়া, ফাস্টফুড দোকান মালিক জামাল উদ্দিনসহ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, কাশিমপুর কারাগার সড়কের পাশে ওই ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনছিলেন রুস্তম। এ সময় তিনজন আরোহী একটি মোটরসাইকেলে চড়ে ব্যস্ততম ওই এলাকায় এসে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে দেয়। স্টার্ট চালু রেখেই ওই মোটরসাইকেল থেকে এক আরোহী নেমে রুস্তমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ডগুলি ছুড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে মোটরসাইকেলযোগেই দ্রুত পালিয়ে যায়। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘটনার পর পরই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাঁদের দোকানপাট বন্ধ করে চলে যায়। এরপর ঘটনাস্থলে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. আব্দুস সালাম সরকার জানান, মৃত অবস্থায় রুস্তমকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁর দেহে ছয়টি গুলি বিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে একটি গুলি তাঁর বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে হৃদপিন্ড ভেদ করে ডান পাশ পর্যন্ত আর অপর একটি গুলি বাম গাল দিয়ে ঢুকে ডান পাশ পর্যন্ত চলে যায়। এ ছাড়া তার বাম হাতের কনুইয়ের নিচে, ডান হাতের তর্জনী, বাম কাঁধের নিচে এবং পেটের একপাশ দিয়ে অপর চারটি গুলি বিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ময়নাতদন্তকালে তাঁর দেহ থেকে দুটি পিস্তলের গুলি বের করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলি গুলো করা হয়েছে। একটি গুলি হৃদপিণ্ড ভেদ করায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের জেলার উম্মে সালমা জানান, রুস্তম আলী বদলি হয়ে ২০১৩ সালের জুন মাসে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-এ যোগ দেন। এরপর তিনি গত বছরের ২৭ অক্টোবর এ মহিলা কারাগারে যোগদান করেন এবং সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ৪ নভেম্বর তিনি অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যান।
রুস্তম ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। এর আগে ২০১১ সালে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১- এ নিয়োজিত ছিলেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ২-এর জেলসুপার প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, রুস্তম পিরোজপুরের বাসিন্দা হলেও সার্ভিস বুকে তার ঠিকানা কুমিল্লা লেখা রয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী নিহত রুস্তমের লাশ হাসপাতালে দেখতে আসেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেন এবং কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। পুলিশ ও র্যাব বিষয়টি তদন্ত করছে। তবে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-এ বেশ কয়েকজন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বন্দি রয়েছে। রুস্তম আলী ওই কারাগারে দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের অবৈধ সুযোগ সুবিধা না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বা তাদের কোনো লোক অথবা ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে অন্য কেউ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করার পরই আমরা বলতে পারব আসলে এটা জঙ্গি সম্পর্কিত কোনো বিষয় না কি অন্য কোনো বিষয় আছে। এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে’। রুস্তম খুনের ঘটনায় নিহতের জামাতাসহ তিন জনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ ছাড়া ঘটনার ব্যাপারে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও পুলিশ কথা বলেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
গাজীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন ও জয়দেবপুর থানার ওসি রেজাউল হাসান রেজা জানান, এটা নিশ্চিত রুস্তম আলী খুনের বিষয়টি জঙ্গি সম্পৃক্ত হামলার কোনো ঘটনা নয়। রুস্তম আলীর জমি ও সম্পত্তি নিয়ে সম্প্রতি তাঁর পালিত মেয়ের স্বামীর (নিহতের জামাতা) সঙ্গে রুস্তমের বিরোধ চলছিল। এর জেরে খুনের এ ঘটনা ঘটেছে কি না, তা তদন্ত করা হচ্ছে।
তবে রুস্তম আলী খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে নিহতের জামাতা সোহেল রানাকে (৩৫) শহীদ তাজ উদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে ফার্মেসির মালিক সাইফুল ইসলাম ও রফিক নামের অপর দুজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাসরিন আক্তার বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দুর্বৃত্তদের গুলিতে রুস্তম আলী নিহতের ঘটনা তদন্তে গাজীপুর জেলা পুলিশ এবং কারা কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এ ব্যাপারে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দারকে প্রধান করে কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. মিজানুর রহমান এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-এর জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম।’
অন্যদিকে গাজীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সোলাইমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-এএসপি মো. মনোয়ার হোসেন, গাজীপুর ডিবির ওসি মো. আমির হোসেন এবং জয়দেবপুর থানার ওসি (তদন্ত) মো. মাহফুজুর রহমান। তাঁদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।