মাদারীপুরে সাপ আতঙ্ক, চিকিৎসক বলছেন মানসিক সমস্যা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/13/photo-1431504201.jpg)
অদৃশ্য সাপের কামড়ের গুজবে এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে মাদারীপুর। গত চার দিনে সদর ও রাজৈর উপজেলার প্রায় ৩৭টি গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ অদৃশ্য সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ওঝা ও কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছেন। আতঙ্কে অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, সাপের কামড় নয়, ছোট ছোট পোকার কামড়ে শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন দাবি করেছেন।
রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের মুসারকান্দি, লুন্দি, হাসানকান্দি, মাঝকান্দি, সাতবাড়িয়া এবং সদর উপজেলার শ্রীনদী, চরনাচনা, বাহাদুরপুর, কালীর বাজার, জাফরাবাদ, কালিকাপুর, দক্ষিণ বীরাঙ্গল, পশ্চিম বাহাদুরপুর, হবিগঞ্জ, মীরাকান্দি, রাধার বাড়ি, সৈয়দ নূর, দুধখালি, ধুরাইল ইউনিয়নের ১১ গ্রাম, কুনিয়া ইউনিয়নের আট গ্রামবাসীসহ ৩৭ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ চার দিন ধরে অদৃশ্য সাপ আতঙ্কে ভুগছেন। ঘুমের ঘোরেও এখন সাপ দেখছেন এসব এলাকার মানুষ। অনেক সময় স্বপ্নে সাপ দেখে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠছেন। ভয়ে মানুষ ঘরের কোনায় কোনায় তাবিজ দিচ্ছেন। দলবেঁধে চলছেন সবাই। নারীদের মধ্যেই এ আতঙ্ক বেশি বিরাজ করছে।
কয়েক দিন আগে সদর উপজেলার বাহাদুরপুরের গৃহবধূ পারুল বেগম সাপের কামড়ে মারা যান। মূলত এর পর থেকেই অদৃশ্য সাপের কামড়ে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার গুজব ছড়াতে থাকে। সাপে কাটা রোগীদের সন্ধান করতে গেলে কাউকেই পাওয়া যায়নি। রাস্তাঘাটে চলতি পথে কীটপতঙ্গের কামড় খেলেও সাপে কামড়েছে আতঙ্কে অনেকেই শরণাপন্ন হচ্ছেন স্থানীয় বিভিন্ন ওঝার বাড়িতে। এর মধ্য দিয়ে ওঝারা হাতিয়ে নিচ্ছেন ৫০০ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েকজনকে সাপে কামড়েছে। এ কারণে তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন। ভয়ে রাতে তো নয়ই, দিনেও ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। শিশুদের নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন তাঁরা।
ওঝা আবুল কালাম বলেন, ‘এটা (ওঝার কাজ) আমার পৈতৃক সম্পদ। আমার দাদা, বাবা, তার পর আমি এ কাজ করছি। আমি আজকে ৪৫ বছর ধরে বিষ নামাইতেছি। বাবার সময় থেকেই বিষ নামাই। আমি সাপের ওঝা নামে পরিচিত। দুই-চার ইউনিয়নের সবাই জানে আমাকে। এই সাপ দেখা যায় না। এই সাপ কামড় দেয়। রোগী হার্টফেল করে, বেহুঁশ হয়ে যায়। তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যখন আমরা ক্ষতচিহ্ন পাই, তখন তার বিষ নামাই। যার ক্ষতচিহ্ন পাই না, তার বিষ নামাই না। টাকাটা কোনো বিষয় না। খুশি হয়ে যে যা দেয়। কেউ পাঁচশ দেয়, কেউ দুইশ দেয়, কেউ তিনশ দেয়। এভাবে বকশিশ দেয়।’
রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. একরাম হোসেন বলেন, ‘আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি, স্থানীয় কয়েকজন ওঝা মানুষকে ভুল তথ্য দিচ্ছে এবং তাদের ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আসলে আমাদের মেডিকেল টিম গতকাল পুরো সন্ধ্যা ওখানে ছিল, তারা ছবি তুলে এনেছেন। তারা পরিষ্কারভাবে দেখেছেন, সাপের কামড় নয়, সিম্পলি ইনসেক্ট বাইট (পোকার কামড়) ছোট ছোট পোকা। এই পোকার কামড়ে স্কিনে রেড স্পট তৈরি হচ্ছে। এর বাইরে কিছুই না।’
মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমার কাছে গত পরশু থেকে খবর আসতেছে। বিভিন্ন উপজেলায়, বিশেষ করে রাজৈর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আমি খবর নিয়ে দেখেছি। বাহাদুরপুরে একজন নারী মারা গেছেন। সেটাকে পুঁজি করে এমনভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে যে এখন পোকামাকড় কামড় দিলেও মনে করছে, হয়তো সাপে কামড় দিয়েছে। এটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে, মাস সাইকোজেনিক ইলনেস (গণমানসিক অসুস্থতা)। সে ক্ষেত্রে আমি মেডিকেল টিম গঠন করেছি। তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করছে। যেখানে ওঝাদের ট্রেস করতে পারছি, সেখানে পুলিশের সহযোগিতায় আমরা অ্যাকশন নিচ্ছি।’
স্থানীয় সচেতন জনসাধারণ প্রশাসনের প্রতি এসব প্রপাগান্ডা ও গুজবের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনের আতঙ্ক দূর করার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে ।