ফয়সাল স্যারকে দমাতে পারেনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি মেধাবী শিক্ষক ফয়সাল রহমান জসীমকে। ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন তিনি। সুন্দর পাঠদানের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় তিনি। রয়েছে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও ক্রীড়াক্ষেত্রেও দক্ষতা। পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও রয়েছে তাঁর সুনাম। কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নেও। প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি বিদ্যালয়ও। যার নাম প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের আস্থা ও ভরসাস্থল ফয়সাল রহমান জসীম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি এখন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। নিজেকে কখনও প্রতিবন্ধী মনে করেন না গুণী এ শিক্ষক।
জানা যায়, প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম না নিয়েও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৮৭ সালের ২৩ এপ্রিল ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা প্যারালাইসড হয়ে যায় ফয়সাল রহমান জসিমের। এ শরীর নিয়ে অদম্য ফয়সাল পড়ালেখা চালিয়ে যান। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরেয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের জনসভায় গিয়ে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন তিনি। সুস্থ হওয়ার পরে ২০০৭ সালে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলায় শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কর্মদক্ষতা দিয়ে জয় করেন নিজের প্রতিবন্ধকতাকে। ২০১৪-১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধিতার ওপর পিএইচডি করেন। দেশ-বিদেশে নিয়েছেন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। বর্তমানে তিনি প্রতিবন্ধীদের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষা জীবন থেকে এখন পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েও কখনও থেমে যাননি।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অন্য শিক্ষকরাও তাকে সব কাজে উৎসাহিত করেন। হুইল চেয়ারে বাসা থেকে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ায়ও সহকর্মীরা সহযোগিতা করছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র আরিফ খান বলে, ‘ফয়সাল রহমান জসিম স্যার আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নেন। তিনি অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। তাঁর পাঠাদানে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আমাদের দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ে জ্ঞান দান করেন।’
শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলাম বলে, ‘স্যার একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী, তবুও তাঁর সব বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে। তিনি আমাদের শিক্ষকই নন, একজন অভিভাবকও।’
ফয়সাল রহমান জসিম বলেন, একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় আমি আহত হই। এরপর নিজের এলাকায় চলে আসি। প্রথমে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পাই। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে সেই চাকরি ছেড়ে দেই। পরে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি পাই। এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছি। একজন প্রতিবন্ধী হলেই যে, তিনি সমাজের বোঝা, আমি এটা মনে করি না। সমাজ উন্নয়নে সব মানুষের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আমি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি। তাদের উন্নয়নে আমৃত্যু কাজ করে যাব। সমাজের বিশেষ শিশুদের জন্য ঝালকাঠিতে কারিগরি একটি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।’
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মারুফা বেগম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হয়েও ফয়সাল রহমান জসিম শিক্ষকতায় সুনাম অর্জন করেছেন, শিক্ষার্থীদের আস্থা ও ভরসাস্থল তিনি। সবসময় তাঁর সফলতা কামনা করি।’
ঝালকাঠি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন ফয়সাল রহমান জসিম স্যার। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি আজ আলোর মুখ দেখেছে। তাঁর মেধা, শ্রম ও আর্থিক সহযোগিতায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের এখানে সব ধরনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বিছানায় শুয়ে থাকত, তারাও এখন হাঁটতে পারছে। সবকিছুই ফয়সাল স্যারের জন্য সম্ভব হয়েছে।’
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, শিক্ষক সবসময় শিক্ষার্থীদের আদর্শ। তাই শিক্ষকতা পেশায় নীতিবান মানুষের প্রয়োজন। ফয়সাল রহমান জসিম তেমনই একজন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা রক্ষায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা যে মানুষের অভিশাপ নয়, তিনি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।’