স্বপ্নজয়ী পিরু মোল্লার বিসিএস ক্যাডার হয়ে ওঠার গল্প শুনলেন প্রধানমন্ত্রী
ফরিদপুর জেলার সোহানপুর গ্রামের ভূমিহীন কৃষক পরিবারের ছেলে পিরু মোল্লা। বাবা-ভাইদের সঙ্গে অন্যের জমিতে সেচ দেওয়া, চুক্তিতে ধান-পাট কাটা, ক্ষেত নিড়ানি দেওয়াই ছিল তার পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস। ঝড়-বৃষ্টির রাতে ছনের ঘরের চালা উড়ে যাওয়ার ভয়ে ঘুম হতো না তার। নানান বাধা-বিপত্তি পাড়ি দেওয়া সেই কৃষকের ছেলে ৪০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাডেমির (ফিমা) সহকারী মহাহিসাবরক্ষক হিসেবে।
স্বপ্নজয়ী এই মানুষের গল্প আজ রোববার (৮ অক্টোবর) শুনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিসিএস কর্মকর্তাদের ৭৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে স্বপ্নবাজ এই তরুণের গল্প শোনেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে চার বিসিএস ক্যাডার তাদের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেন। এদের মধ্যে পিরু মোল্লাও একজন। পিরু মোল্লা বলেন, ‘আজ আমি স্বপ্নপূরণ ও ভাগ্য বদলের গল্প বলতে এসেছি। এই স্বপ্নপূরণ আমার মতো হাজারও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের। এই ভাগ্যবদল চিরায়ত বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি প্রাণের।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে পিরু মোল্লা বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু, বিজ্ঞান বিভাগের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেতে পারব কি-না, সেই শঙ্কা ছিল। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নটা প্রায় শেষই হতে যাচ্ছিল, যদি না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেতাম। কেন না, অর্থের অভাবে কেবল রাবি ছাড়া অন্য কোথাও আমি ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে পারিনি।’
পিরু আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়ার সময় মাঝে-মধ্যেই আমার ভাইয়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজে যেতে হতো। টিউশনি না পাওয়া পর্যন্ত প্রথমবর্ষে বেশিরভাগ সময় আমি সকালে নাস্তাও করতে পারিনি। হলে ১৫ টাকায় দুপুরের খাবার, আর ১২ টাকায় রাতের খাবার এই মোট ২৭ টাকায় দুবেলা খাবারের খরচ মিটতো। রাতের খাবার থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে... আমার মনে আছে, ল্যাব থেকে আসার সময় ক্ষুধায় বাঁকা হয়ে যেতাম আমি।’
পিরু মোল্লা বলেন, ‘এমন একটা অনিশ্চিত জীবন থেকে উঠে এসে আজকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানায়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অসংখ্য তরুণের মতো আমারও স্বপ্ন ছিল সিভিল সার্ভিসের চাকরি। প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে আপনি মেধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিত করেছেন। ফলে, ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে পেরেছি। এ জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।’
এই বিসিএস ক্যাডার জানান, ২০২০ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই তার বাবার ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ে। এর দুই মাস আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার ভগ্নিপতি মারা যান। সন্তান সম্ভবা বোন ও তার দুই সন্তানের ঠাঁই হয়েছিল তারই পরিবারে। চরম আর্থিক সংকটে তার বাবার চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
পিরু মোল্লা বলেন, ‘ওই সংকটের সময় সরাসরি আপনার (প্রধানমন্ত্রীর) কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। আশা ছিল, হয়তো সাড়া পাব। কিন্তু, এত দ্রুত সাড়া পাব, এটা ছিল কল্পনাতীত। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক আমার বাবাকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য প্রদানের খবরটি জানান। কিন্তু, চিকিৎসা শুরুর মাত্র ১৫ মাস পরেই আমার আব্বা মারা যান। এর কিছু দিন পর মেজো ভাই ও বিধবা বোনের শরীরেও ক্যানসার শনাক্ত হয়।’
দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন রূপে পরিচিত করেছেন বলে উল্লেখ করে এই তরুণ কর্মকর্তা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। আমি গ্রামে যাই পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসার পথে বলতাম, আব্বা, আর কয়টা দিন কষ্ট করেন। ইনশাআল্লাহ, কেমো থেরাপির এই ধকল নিয়ে আপনাকে আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সেই প্রমত্ত পদ্মা এখন চোখের পলকে পার হয়ে যাওয়ার সময় অনুভব করতে পারি, আপনি কীভাবে এ দেশের মানুষের চিরায়ত দুঃখের গল্পগুলোকে আনন্দের আখ্যানে পরিণত করেছেন।’