অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে যা ঘটেছিল
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/04/05/byaank-bybsthaapk-nijaam_0.jpg)
অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধারের পর সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আজ শুক্রবার (৫ এপ্রিল) র্যাব সদর দপ্তরের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ইমরান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নেজামের সঙ্গে অপহরণের সময়র ঘটনাগুলো তুলে ধরেন। একইসঙ্গে জানান, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব সদস্যরা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বান্দরবানের বাথেলপাড়া এলাকা থেকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজামকে উদ্ধারকরা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২ এপ্রিল রাত আনুমানিক ৮টা ১৫ মিনিটে বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা বাজারস্থ সোনালী ব্যাংকে শতাধিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত কুকি-চিন সদস্য সোনালী ব্যাংকের উত্তর দিক (বেথেল পাড়া) থেকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অতর্কিত হামলা করে। বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ নিয়ে হামলা করে তারা অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য লোকজনদেরকে জিম্মি করে ফেলে। আক্রমণের সময় সোনালী ব্যাংকের ডিউটিরত গার্ড কনস্টেবলসহ ১০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুটি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি, আটটি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি, আনসার সদস্যদের চারটি শর্টগান ও ৩৫ রাউন্ড কার্তুজ ও সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুটের চেষ্টা এবং সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার মো. নেজাম উদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
খন্দকার মঈন বলেন, এরপর র্যাবের আভিযানিক দল একপর্যায়ে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান শনাক্ত করে। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কৌশলে বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের ফলে সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। ব্যাংক ম্যানেজারকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরকালীন যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা অপহরণের শিকার না হয় সে জন্য র্যাব সুকৌশলে হস্তান্তর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে র্যাবের একদল চৌকস সাদা পোশাকধারী সদস্য রুমা থানাধীন বেথেলপাড়া এবং বড়ুয়া পাড়ার আশেপাশে অবস্থান নেয়। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আনুমানিক সাতে ৭টায় সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে পরিবারে কাছে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয় এবং এরপর র্যাব সদস্যরা নেজাম উদ্দিন এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বান্দরবানের র্যাব-১৫ ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নেজাম উদ্দিন র্যাবের কাছে সন্ত্রাসীদের অর্তকিত হামলা ও হামলার পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। গত বুধবার রাত ৮টার সময় বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা থানাধীন রুমা বাজারস্থ সোনালী ব্যাংকে শতাধিক সশস্ত্র কুকি-চিন সদস্য সোনালী ব্যাংক ডাকাতির উদ্দেশে ব্যাংক এবং আশপাশ এলাকায় ভীতি সঞ্চার করে ব্যাংকের ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। সন্ত্রাসীরা কোনো একজনের মাধ্যমে জানতে পারে, সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিন পার্শ্ববর্তী মসজিদে অবস্থান করছেন। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত মুসল্লিদের জিম্মি করে প্রত্যেকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন তাদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। অতঃপর তারা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে শনাক্ত করতে না পেরে মসজিদ থেকে তিনজনকে বের করে আনে এবং ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কি না? ম্যানেজার ব্যাপারটি অপ্রীতিকর মনে করে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সন্দেহ হলে তারা ম্যানেজারসহ তিনজনকে ব্যাংকে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত প্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ব্যাংক ম্যানেজারকে শনাক্ত করে।
সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি দল ব্যাংক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের অস্ত্র ও গুলি নিয়ে তাদের একটি রুমের মধ্যে আটকে রাখে। একইসঙ্গে ব্যাংকের চারপাশে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘিরে রাখে। এ সময় সন্ত্রাসীদের সবাই এক ধরণের সামরিক পোশাক পরিহিত ছিল এবং প্রত্যেকের মুখমন্ডল কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল।
খন্দকার আল মঈন বলেন, তারপর ম্যানেজারের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জানতে চায়, ব্যাংকে কত টাকা নিয়ে আসা হয়েছে এবং ব্যাংকের ভল্টে মোট কত টাকা রক্ষিত রয়েছে? সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে ম্যানেজারের নিকট ব্যাংকের ভল্টের চাবি চাইলে ম্যানেজার তাদের কৌশলে ভল্টের চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে সন্ত্রাসীরা ভল্ট ভাঙ্গতে চেষ্টা করে এবং পরে ম্যানেজারের কাছ থেকে আরও জানতে পারে যে, ভল্টে আঘাত করলে সেন্সরের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যাপারটি সোনালী ব্যাংকের হেড অফিস জেনে যাবে। তখন তারা ব্যাংকে ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছানো মাত্রই তার চোখ বেঁধে ফেলে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ব্যাংক থেকে ম্যানেজারকে বের করে টানা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কোনো একটি পাহাড়ের ঝিরি পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় তার সাথে ১০ থেকে ১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছিল। পথিমধ্যে তারা ম্যানেজারের চোখ বাধা খুলে দেয় এবং অন্ধকারে চলার সুবিধার্থে ম্যানেজারের হাতে একটি বাটন ফোন ধরিয়ে দেয়। পথে তারা কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেয়। এরপর আবার হাঁটায় একপর্যায়ে রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় নীরব অজ্ঞাত এক স্থানে তাকে নিয়ে গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ দেয় এবং ম্যানেজার যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তারা পাহারা দেয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ঘটনার পরদিন, অর্থাৎ গত ৩ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টার সময় ব্যাংক ম্যানেজারকে সামান্য নাস্তা দিয়ে আবারও হাঁটিয়ে পাহাড়ি ঝিরি পথ দিয়ে অন্য একটি পাহাড়ের ঝিরিতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জনের মত সশস্ত্র সন্ত্রাসী অবস্থান করছিল। এ সময় তারা কলার পাতায় করে ম্যানেজারকে গরম ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খেতে দেয় এবং সেখান থেকে হাঁটিয়ে অন্য জায়গায় পুনরায় নিয়ে যায়। সেখানে ম্যানেজারকে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো বিশ্রামের সুযোগ দেয়। এরপর সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টা পর্যন্ত তারা ধাপে ধাপে বিশ্রাম এবং হাঁটার পর ভিন্ন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছালে এ সমময় তারা ম্যানেজারকে গরম ভাত, ডাল ও ডিম খেতে দেয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, সন্ত্রাসীরা সবসময় নিজেদের মধ্যে বম ভাষায় কথা বললেও ম্যানেজারের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলত। সব সময় তাকে দুই থেকে তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘিরে রাখত এবং ১২ থেকে ১৩ জন তার আশে পাশে অবস্থান করত। অতঃপর রাত আনুমানিক ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে একটি টং ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে নুডলস খেতে দেয়। যদিও ম্যানেজার তা খাননি। ওই রাতে টং ঘরে ম্যানেজারের সঙ্গে পাহারারত পাঁচজন সন্ত্রাসী ঘুমায়।
৩ এপ্রিল রাত আনুমানিক ৮টা থেকে পরের দিন বিকেল প্রায় ৩টা পর্যন্ত তারা প্রায় একই জায়গায় ছিল। অতঃপর বিকেল তিনটার পর প্রায় এক ঘন্টা হেঁটে তাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারকে মোটরসাইকেল যোগে নতুন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয় এবং কোন প্রশাসনিক বা আইনি সহায়তা যাতে না নেয় তার পরিবারকে সেজন্য সর্তক করে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ায় ওই সূত্র ধরে র্যাব তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান শনাক্ত করে এবং র্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে বান্দরবানের রুমা বাজার ও বেথেল পাড়া মধ্যবর্তী কোনো একটি স্থান থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।