যৌথ অভিযানের মুখে আত্মগোপনে কুকি-চীন
বান্দরবানে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানে এ পর্যন্ত ৫৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেএনএফের একজন উপদেষ্টাও রয়েছেন বলে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
অভিযানে কেএনএফের অস্ত্র উদ্ধারের কথা জনানো হলেও রুমার ব্যাংক থেকে লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। থানচির দুই ব্যাংক থেকে ডাকাতি হওয়া টাকাও উদ্ধার হয়নি বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর বন্দরবান রুমা জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম আরাফাত আমিন।
যৌথ অভিযানে রুমা ও থানচি এলাকায় আট শতাধিক সেনা, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্য মোতায়েন আছে। এই দুটি উপজেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। রুমা ও থানচি এলাকার জনজীবন এখনো স্বাভাবিক হয়নি৷ সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এই অবস্থার মধ্যেই পাহাড়ে শুরু হয়েছে নববর্ষ উৎসব বৈসাবি (বিজু, সাংরাই, বৈসুক)। অভিযানের মধ্যে চলাচল ও নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি পণ্য পরিবহণে নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। তবে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই বলে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
যৌথ অভিযানে সর্বশেষ কেনএনএফের একজন উপদেষ্টা লাল লিয়ান সিয়াম বমকে আটক করা হয়েছে ১০ এপ্রিল। এ নিয়ে যৌথ অভিযানে মোট ৫৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সাতটি দেশীয় বন্দুক, ২০টি গুলি, ল্যাপটপ, ইউনিফর্ম, বুটসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের স্ত্রী রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স লাল সমকিম বমকে বদলি করা হয়েছে। তাকে লালমনিরহাট ২৫০ শয্যার হাসপাতালে বদলি করা হয়।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, ‘যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান আছে। এই অভিযানে আমরা কুকি-চীনের সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’
গত ২ এপ্রিল রাতে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংক এবং পরের দিন ৩ এপ্রিল দুপুরে একই জেলার থানচি উপজেলার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালায় কেএনএফ সদস্যরা। তারা রুমার ব্যাংক থেকে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং থানচি থেকে ১১ লাখ টাকা ডাকাতি করে নিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনীর অভিযানের টার্গেট
সেনাবাহিনীর বন্দরবানের রুমা জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম আরাফাত আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কেএনএফের সন্দেহভাজন অবস্থানগুলোতে তল্লাশি অব্যাহত আছে। তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রসহ নানা ইকুইপমেন্ট উদ্ধারে তল্লাশি চলছে। আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য কেএনএফ এবং তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা। তবে সাধারণ মানুষ ও যানবাহন চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। যেহেতু এখানে অপারেশন চলছে। তারা বেশ কিছু সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করেছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষের চলাচল যেভাবে স্বাভাবিক হয়, অতটা স্বাভাবিক নেই। লোকজন চলাফেরা করছে, তবে কম। আমরা কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিনি। তারা হয়ত চিন্তা করছেন একদম জরুরি কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজ পরে করবেন। এ কারণে মুভমেন্ট কম, গাড়ি-ঘোড়া একটু কম চলছে।”
লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম আরাফাত আমিন আরও বলেন, “রুমা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। সেখান থেকে তারা ব্যাংকের টাকা নিতে পারেনি। আর থানচির দুই ব্যাংক থেকে যে টাকা তারা লুট করেছে তা-ও উদ্ধার হয়নি। অস্ত্র ও টাকা উদ্ধারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। তবে আমরা ওদের ব্যবহৃত অস্ত্র, পোশাক, মোবাইলফোন, ল্যাপটপ এগুলো উদ্ধার করেছি। এখানো কুকি-চীনের কিছু সদস্য পাহাড়ে ও পাহাড়ি জনপদে আত্মগোপন করে আছে। তারা পাহাড়ের খাদে, গিরিতে লুকিয়ে আছে। কিছু পালিয়ে গেছে। কিছু পালানোর চেষ্টা করছে। তাদের সঠিক অবস্থান আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।”
কে এম আরাফাত আমিন বলেন, “নাথান বমের বাড়ি রুমা সদরে হলেও দুই বছর ধরে তিনি এখানে আর থাকেন না। তার অবস্থান সম্পর্কে আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে। আমরা তাকে সর্ভিলেন্সে রেখেছি।”
বর্তমান পরিস্থিতি
বম সম্প্রদায়ের লোকজন বোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচির একাংশে বসবাস করেন। তাদের মোট জনসংখ্যা ১৭ হাজারের মতো হবে বলে জানান কেএনএফের সঙ্গে শান্তি সমঝোতা কমিটির সদস্য সচিব কাঞ্চন জয় তঙচঙ্গা। তিনি বলেন, “ওই তিন এলাকায় অভিযানের কারণে সেখানে কিছুটা থমথমে অবস্থা রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের অন্য এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের বৈসাবি উৎসব শুরু হয়ে গেছে। এই উৎসবে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তবে বম সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক আছে।”
রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উহ্লামং মার্মা বলেন, “অভিযান চলার মধ্যে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বম সম্প্রদায়ের অনেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিশেষ করে রুমা সদরের হেডপাড়া এলাকা, যেখানে নাথান বমের বাড়ি, সেখান থেকে অনেক বম পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়েছে বলে জানা গেছে।”
থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াই হ্লা মং মার্মা বলেন, “পুরো জেলায় যানবাহন বা জন চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে অভিযান চলার কারণে বাইরে লোকজন কম বের হচ্ছে। আর কুকি-চীনরা যানবাহন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল৷ সেই কারণে যানবাহন চলাচল কম। একদিকে ঈদ, অন্যদিকে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব- ফলে এমনিতেও লোকজন কম।”
এক প্রশ্নের জবাবে থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “যেসব এলাকা ‘সন্দেহজনক’, আর বম জনগোষ্ঠী যেখানে বসবাস করে, তাছাড়া সন্দেহভাজনদের চলাচলে পথে নিষেধাজ্ঞা ও নজরদারি আছে। পাঁচ কেজির বেশি চাল পরিবহণ না করাসহ আরো কিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে তারা আছেন।”
রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মারমা বলেন, “অভিযানের ‘টার্গেট’ বম সম্প্রদায়। কেএনএফের প্রধান নাথান বম ওই সম্প্রদায়ের। তবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সবার চেহারা তো প্রায় একই রকম। ফলে চেহারা দেখে বমদের সাধারণভাবে চেনা যায় না। এ কারণে অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যেও আতঙ্ক আছে। আসলে এই এলাকার পরিস্থিতি এখন থমথমে। ব্যবসা-বণিজ্যও তেমন চলছে না। ব্যাংকের শাখাগুলো এখন জেলা সদরে নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।”
রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মারমা বলেন, “পাঁচ কেজির বেশি চাল পরিবহণে বমদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা আমার জানা নেই। তবে অভিযানের কারণে কোনো কোনো বম পরিবার আত্মগোপনে গিয়ে থাকতে পারে। অভিযানের কারণে কেউ চলে গেছে, কেউ পালিয়ছে- এরকম হয়েছে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “বৈসাবি উৎসবে কোনো বাধা নেই। সরকারের দিক থেকে কোনো নিষেধও নাই। তারপরও যে পরিস্থিতি বুঝতেই পারছেন, তাতে উৎসব তো সেইরকম হয় না।”
আর র্যাব ১৫-র কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এইচ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানে আছি। এই অভিযান চলবে। ওই এলাকায় যানবাহন, পণ্য পরিবহণ বা জন চলাচলে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নাই। সাধারণ ও নীরিহ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি।”