ঈদযাত্রায় সড়ক, নৌ ও রেল দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮ : যাত্রীকল্যাণ সমিতি
পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে যাতায়াতে দেশে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত এবং ১৩৯৮ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছে। নৌপথে দুটি দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ পথে সর্বমোট ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১৪২৪ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আজ শনিবার (২০ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব তথ্য তুলে ধরেন।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর ঈদকেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ মানুষের বেশি যাতায়াত হয়েছে। বর্তমান সরকারের বিগত ১৫ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় ভালো থাকায় যানবাহনে গতি বেড়েছে। দেশের সবকটি সড়ক-মহাসড়কের পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচলের কারণে মোট যাত্রীর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মোটরসাইকেলে যাতায়াত হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি চরমে উঠেছিল। গণপরিবহণগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের কারণে বাসের ছাদ, ট্রেনের ছাদ, খোলা ট্রাক ও পণ্যবাহী পরিবহণে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র লোকজনের ঈদে বাড়ি যেতে হয়েছে।
সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৪ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিগত ১৫ দিনে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত এবং ১৩৯৮ জন আহত হয়েছে। বিগত ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত ও ৫৬৫ জন আহত হয়েছিল। বিগত বছরের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, আহত ১৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত এবং ২৪০ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং আহতের ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রায়।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত মোট যানবাহনের ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ ভ্যান-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কার মাইক্রো জিপ, ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ অটোরিকশা, ১২ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাস রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৫০ দশমিক ৬২ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এ ছাড়াও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গত ১৫ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে অবকাঠামো ভালো হওয়ায় যানবাহনের গতি বেড়েছে। গতিকে নিরাপদ করার মতো আইনি কাঠামো, দক্ষ চালক, মানসম্মত যানবাহনের অভাব রয়েছে। আইন প্রয়োগে দুর্নীতির কারণে জাতীয় মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, নিষিদ্ধ ত্রি-হুইলার, ইজিবাইকের মতো যানবাহন অবাধে চলছে। এ ছাড়াও ছোট ছোট যানবাহন মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজিবাইকের অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।’
মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধ করে দেশব্যাপী উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব। একইসঙ্গে তিনি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ ঠেকানো, আইন প্রয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে গণপরিবহণগুলোতে নগদ অর্থ বন্ধ করে ডিজিটাল লেনদেন চালুর দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুরন্নেছা খান, গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ আব্দুল হক, সংগঠনের সহসভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ।