নিজেদের মধ্যে সংঘাতে রক্ত ঝরাচ্ছে আওয়ামী লীগ
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাস জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশ রাজনৈতিক সহিংসতা ও দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। তাদের মধ্যে ২৭ জনই আওয়ামী লীগের। এই হিসাব মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)।
তবে আসক দেশের বাইরে নিহত হওয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হিসাবের মধ্যে ধরেনি। তাঁকে ধরলে আওয়ামী লীগের নিহতের সংখ্যা পাঁচ মাসে ২৮ জন। আসকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই পাঁচ মাসে দেশে মোট রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৩৯৩টি। এইসব সংঘাতের ঘটনায় আহত হয়েছেন তিন হাজার ২২৪ জন।
৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এরপর হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এরমধ্যে কিছু পৌর নির্বাচনও হয়েছে। জাতীয় সংসদ এবং উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নেয়নি। উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পেরেছেন। ফলে এই নির্বাচনে বলতে গেলে দলীয় এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে অধিকাংশ প্রার্থীই ছিলেন আওয়ামী লীগের। উপজেলা নির্বাচনেও তাই। ফলে গত পাঁচ মাসে ৩৯৩টি রাজনৈতিক সহিংস ঘটনার ২০১টিই হয়েছে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। প্রকৃত পক্ষে এই সংঘাতগুলো আওয়ামী লীগের সাথে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডগুলোও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে হয়েছে। বাকি সংঘাতগুলোর ৯০ ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বেরও ফল।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগৈর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তার জের উপজেলা পরিষেদ নির্বাচনেও দেখা যায়। আর উপজেলা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগেরে তৃণমূলে এই দ্বন্দ্ব সংঘাত আরো বাড়ছে। আর এই সংঘাতে আয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, জেলা ও তৃণমূলের নেতারা হত্যার শিকার হয়েছেন।
গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের তিন নেতা খুন হয়েছেন। রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জেলা পরিষদের সদস্য এবং নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক সুরুজ মিয়াকে।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি হত্যারই পেছনে আছে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা। স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, বালুমহলের আধিপত্য ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ওই হত্যাগুলো ঘটে। আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের। আর এইসব হত্যাকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের উত্তেজনা ও বিভাজন আরো তীব্র হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল মনে করেন, “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের তৃণমৃলে দ্বন্দ্ব সংঘাত বেড়ে যায়। উপজেলা নির্বাচনে তা আরও প্রকট হয়। এর পেছনে আছে আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। আর এখন মাঠে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তেমন না থাকায় তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে।”
গত ১২ জুন চাঁদপুর শহরের পুরানবাজারে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে আল আমিন খান (৩২) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে নিহত হন। এ ছাড়া ৩০ জন আহত হন। গত ২৬ জুন ঢাকার কদমতলী এলাকায় যুবলীগের দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে চারজন আহত হন।
একই দিনে মুন্সীগঞ্জে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের মুন্সিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ আটজন আহত হন। গত ২৭ জুন ঝিনাইদহের শৈলকুপায় মীনগ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত আটজন আহত হন। গত ২৪ জুন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে অন্তত ৯ জন।
২৩ জুন রাজবাড়ীর পাংশায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। গত ২২ জুন নেত্রকোনা কলমাকান্দা উপজেলায় বাজারের ইজারা নেওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৩০ জন আহত হন।
৭ জুন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে একই জায়গায় উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের আনন্দ মিছিল ও আলোচনা সভার সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন।
গত ১৩ মে কলকাতায় ভারতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার নিহত হওয়ার ঘটনায় ওরফে মিন্টু এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুও গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফলে ওই হত্যাকাণ্ডে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হচ্ছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট যে তৃণমূলে আওয়ামী লীগে এখন ব্যাপক গ্রুপিং লবিং। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সেটা আরও তীব্র হয়েছে। এই নির্বাচনে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৬২ জন আছেন আওয়ামী লীগের। তারা এমনিতেই শক্তিশালী তারপরও তারা আরও শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছেন। কারণ আওয়ামী লীগ মনোনীত পরাজিত নেতারা তাদের দলীয় অবস্থান ধরে রেখে সংসদ সদস্যকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। এছাড়া গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে অন্য দল থেকে অনেকে যোগ দিয়েছেন। তারা মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিতও হয়েছেন। তারাও আলাদা গ্রুপ পরিচালানা করেন। আর প্রত্যেক এলাকায়ই এমপি অনুসারী এবং তাদের একটি বিরোধী গ্রুপ আছে। উপজেলা নির্বাচনে এই গ্রুপিং আরও তীব্র হয়েছে। ফলে তৃণমূলে এই গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আছে স্থানীয় পর্যায়ে নানা ধরনের চাঁদবাজি, দখলবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের বিষয়।
বরিশালের বানারীপাড়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির সরদার বলেন, “আমাদের এখানে নানা গ্রুপ। এমপি গ্রুপ, উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রুপ, সভাপতি গ্রুপ। গ্রুপের আর শেষ নাই। জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরো নতুন নতুন গ্রুপ হয়েছে।”
আওয়ামী লীগের সহ সম্পাদক এবং ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মনিরুজ্জামান মনির ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। তার কথা, “এখন তৃণমূলে যে পরিমাণ গ্রুপিং শুরু হয়েছে তা দলের জন্য অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। নিজেরা নিজেদের রক্ত ঝড়াচ্ছে। শক্তি ক্ষয় করছে। সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তারা প্রত্যেকে এখন নতুন একটি গ্রুপ করেছেন। যারা বাইরে থেকে আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন তাদের গ্রুপ আছে। আবার কেন্দ্রীয় নেতারাও বিভিন্ন এলাকায় তাদের অনুসারী গ্রুপ তৈরি করেছেন। সব মিলিয়ে এখন তৃণমূল আওয়ামী লীগ গ্রুপিংয়ে বিপর্যস্ত। এর ফলে সংঘাত সংঘর্ষ প্রকট হচ্ছে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সদস্য এস এম কামাল হোসেন বলেন, “আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রুপিংয়ের কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়। কেউ সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে আমরা দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিই। আর ফৌজদারি অপরাধের কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা দেখার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে।”
এস এম কামাল হোসেন আরও বলেন, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দল। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগ বার বার ক্ষমতায় আসছে। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা দিয়ে আওয়ামী লীগকে মূল্যায়ন করা যাবে না।”