দেশ ছাড়ছেন আ.লীগের মন্ত্রী-এমপিরা, কে গেলেন কোন দেশে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। এরপরই ভয়াবহ বেকায়দায় পড়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা। অনেকে সুযোগ বুঝে দেশ ছাড়তে পারলেও আটকে পড়া অনেক এমপি-মন্ত্রী ও অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের অনেকে আবার বিভিন্ন দূতাবাসে আশ্রয়ও চেয়েছেন।
গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টারে ভারতের উদ্দেশে উড়াল দেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্তে কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী দেশ ছাড়তে না পেরে দেশে গা ঢাকা দেন। এমনকি, মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েছেন বলেও খবর চাউর হয়েছে।
সূত্র বলছে, গত শনিবার (৩ আগস্ট) বিকেল থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গা ঢাকা দিয়েছেন। গত শনিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেষবারের মতো কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। সূত্র বলছে, রোববার রাতেই দেশত্যাগ করেছেন ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুর রয়েছেন। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, ওবায়দুল কাদের বর্তমানে নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বিমানযোগে দেশ ছাড়েন।
এছাড়া রোববার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটে দেশ ত্যাগ করেন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর। মূলত এর পরপরই গণহারে মন্ত্রী-এমপিদের দেশ ত্যাগের হিড়িক শুরু হয়।
রোববার এমপি-মন্ত্রী ও সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অনেকে বিশেষ প্রটোকল চেয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে চিঠি দেন।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এভসেক-এর সহকারী পরিচালক নাছিমা শাহীনের সই করা তালিকা অনুযায়ী দেশ ছাড়া এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন পূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির (বিজি ৩৯৮), সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী (বিজি ৫৮৪), স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম (বিজি ৩৮৮), সাবেক হুইপ নুর-ই আলম চৌধুরী (বিজি ৩৮৮), কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ (বিজি ৩৮৮) ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ (ইকে ৫৮৭), এমপি নুর-ই হাসনা লিলি চৌধুরী ও তার পরিবার (ইকে ৫৮৫), উত্তরা এলাকার সাবেক এমপি হাবিব হাসান (বিজি ৫৮৪) এবং জেপি প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (এসকিউ ৪৭৪)। গত ১৫ জুলাই মধ্যরাতে দেশ ছাড়েন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া ১৬ জুলাই একই দিন পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে কুমিল্লা-১১ আসনের এমপি ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক দুবাই যান।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপিকা রুমানা আলী টুসি ১৬ জুলাই যান মালয়েশিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন পরিবারের চার সদস্য। এদিন আরও দুই এমপি বিদেশ যান। যাদের মধ্যে রয়েছেন ময়মনসিংহ-৮ আসনের এমপি মাহমুদ হাসান সুমন। তিনি পরিবারের চার সদস্য নিয়ে গেছেন সিঙ্গাপুরে। অপরজন হলেন কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। তিনি গেছেন চীন। ১৭ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে ঢাকায় ফেরেন চট্টগ্রাম-১ আসনের এমপি মাহবুব উর রহমান। এ সময় ঢাকা-৫ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজল ভারত সফরে ছিলেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৭ জুলাই। ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব দুবাই গেছেন ২৭ জুলাই। সিলেট-১ আসনের এমপি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আগে থেকেই ছিলেন আমেরিকায়।
সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পারভীন জামান গত ২৬ জুলাই ব্যাংকক গেছেন। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান ২৫ জুলাই কানাডা গেছেন। চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি শফিকুর রহমান ১৮ জুলাই স্ত্রীসহ যুক্তরাষ্ট্রে যান। কুমিল্লা-৩ আসনের এমপি জাহাঙ্গীর আলম সিঙ্গাপুর গেছেন ২৮ জুলাই।
এদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দেশেই আত্মগোপনে আছেন বলে জানা যায়। বিশেষ করে সোমবার বিকেল পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তার বনানীর বাসায় অবস্থান করছিলেন। সরকারের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সন্ধ্যার পর থেকে তার সঙ্গে নেতাকর্মীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।
সূত্র জানায়, এমপি-মন্ত্রীদের অনেকে শেষ মুহূর্তে শত চেষ্টা করেও আর দেশ ছাড়তে পারেননি। রোববার ও সোমবার দু’দিন টিকিটের জন্য তারা বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বিফল হন। অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে বিদেশ পাঠাতে পারলেও নিজে আর যেতে পারেননি।
অন্যদিকে, পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জনসমাগম এড়িয়ে অবস্থান নিয়েছেন। অনেকেই নিজেদের বাসা বা সরকারি বাংলোতে না গিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করছেন।
এছাড়া, গত রোববার বিদেশ ভ্রমণ করার কথা ছিল বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, ভিআইপি ও সিআইপির। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের মাধ্যমে যারা বিদেশ ভ্রমণের করেছেন তাদের নাম এখনও জানা যায়নি।