তাসের ঘরের মতো ভাঙল স্বৈরশাসন, বিশ্বাসভঙ্গে হতবাক অনেকেই!
রেজা রহমান জানেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে দেশ ও ক্ষমতা দুটোই ছেড়ে পালিয়েছেন। কিন্তু, তিনি এখনও যেন ঘোরের মধ্যে আছেন। অবাক তার চোখ-মন! ভাবতেই পারছেন না, এতদিন যে হাসিনা নিজেকে শক্তিশালী ভাবতেন, তার সাম্রাজ্য হঠাৎ এভাবে ভেঙে পড়বে। শুধু রেজা নন, তাঁর মতো অনেকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে—তাসের ঘরের মতো শেখ হাসিনা সরকার ভেঙে চুরমার। এতদিন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগের যেসব নেতাদের প্রতাপের সঙ্গে কথা বলতে দেখতেন, তাদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রেজা রহমান গত ৪ আগস্ট রাতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় বলেছিলেন, ‘আজও কমপক্ষে ১০০ জন মারা গেছে। তারপরও শেখ হাসিনার কিছু হবে না। দেখেন, তিনি সব সামাল দিয়ে ফেলবেন। আরও হাজার হাজার লাশ পড়লেও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বেন না। যেভাবেই হোক, ক্ষমতা তার চাই-ই চাই। নতুবা তিনি নিঃশেষ হয়ে যাবেন। সেজন্য, রক্তের নেশা তার পেয়ে বসেছে।’
পরদিন ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। ওদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গণভবনমুখী ছাত্র-জনতার জোয়ারে নির্মম-নিষ্ঠুর স্বৈরাচারের পতন হয়। শেখ হাসিনা দেশ ও ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার দাবি, ‘শতশত মানুষের রক্তের বিনিময়ে দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে। স্বৈরাচার নিপাত গেছে। স্বাধীনতা এসেছে।’
৫ আগস্ট রাতে এবার রেজা রহমান বলেন, ‘আমার শরীরে একটু চিমটি কাটুন তো! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, শেখ হাসিনা ক্ষমতা এভাবে পালিয়ে যেতে পারেন। কী ক্ষমতাইনা দেখাল গত ১৬ বছর। কাউকে পরোয়া করেননি। কী নির্মম পরিহাস!’
সে সময় রেজার পাশে থাকা আরেকজন বলে উঠলেন, ‘এতোকিছুর পরও আমার মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা আর ভারত মিলে আবারও কিছু করবে। আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না, শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের এভাবে বিপদে রেখে পালাতে পারেন।’
৬ আগস্ট বিকেল। সাতক্ষীরার জেলার থানা ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতি পালিয়ে এলাকা ছাড়ছিলেন। মুঠোফোনে তার সঙ্গে কথা হলে বলেন, ‘আমাদের ও অন্দোলনরতদের মুখোমুখী করে দিলেন। সর্বোচ্চ প্রতিরোধ করতে বললেন। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আর পরে তিনিই, মানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন! এটা বিশ্বাস করতেই আমার একদিন লেগেছে। মিডিয়ায় খবর আসার পরও ৫ আগস্ট রাতে আমার মনে হচ্ছিল, যেকোনো মূল্যেই হোক শেখ হাসিনা দেশে রয়েছেন এবং তিনি কিছু না কিছু করবেন।’
৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের (এসি) সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। কথা প্রসেঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতাম, শেখ হাসিনা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়বেন না। পালানোর তো প্রশ্নই আসে না। কারণ, ক্ষমতা ছাড়লে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে, এমন ধারণা আমার মধ্যেও ছিল, যা ছিল ভুল। আদতে এতো মানুষ মরেনি। আর আমাদের জনতার মুখে ঠেলে তিনি পালিয়ে যাবেন, যা আমি কখনোই ভাবিনি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আমার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাস করছিলাম, শেখ হাসিনা কি সত্যিই পালিয়েছেন?’ আমার স্ত্রীও অবিশ্বাসী মন নিয়ে হাতে চিমটি কাটল। তারপর বলল, তারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বিষয়টি।’
আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর কাঁঠালবাগানের এক বাড়ির মালিক কথার ছলে বলছিলেন, ‘এভাবে তাসের ঘরের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়বে, কখনও কল্পনা করিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে এতো এতো নির্যাতন-হামলা-মামলার শিকার হয়েছি, যার কথা ভুলতে পারি না। এসব মনে পড়লেই শরীর শিউরে ওঠে। আনমনে ভেবে বসি, একটু পরেই বিভিন্ন মামলায় পুলিশ আমাকে ধরতে আসবে।’