থানা লুটের অস্ত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে জনজীবন
সম্প্রতি পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে দামদর করার সময় ধরা পড়েছে তরুণ৷ থানা-লুটের অস্ত্র নিয়ে টিকটক করতে গিয়ে প্রাণ গেছে যুবকের৷ এমন পরিস্থিতিকে জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ তাঁরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু এখন সময়ের দাবি৷
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দিন গত ৫ আগস্ট নিরাপত্তা দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়৷ সারা দেশের চার শতাধিক থানা থেকে লুট হয় পুলিশের কয়েক হাজার অস্ত্র ও গোলাবারুবদ৷ শুধু পুলিশের অস্ত্র নয়, থানায় জমা থাকা সাধারণ মানুষের অস্ত্রও খোয়া গেছে৷ কিছু ফেরত পাওয়া গেলেও অধিকাংশই উদ্ধার হয়নি৷
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, সোমবার (১৯ আগস্ট) বিকেল পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে ৮২৬টি ফেরত পাওয়া গেছে৷ এর বাইরে ২০ হাজার ৭৭৮ রাউন্ড গুলি, এক হাজার ৪৮২টি টিয়ারশেল ও ৭১টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে৷ তবে কী পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ খোয়া গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান এখনও করতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর৷ খুব শিগগিরই এই তালিকা করা সম্ভব হবে বলে কাছে আশা প্রকাশ করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর৷ তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৮২৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷ উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে৷ নিকটস্থ থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি আমরা৷’
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের লুট হওয়া ৯৭টি অস্ত্র, ছয় হাজার ৫৮৫ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ২৮টি ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে৷ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি, শিগগির অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু করা প্রয়োজন৷ এ ক্ষেত্রে যৌথ অভিযান শুরু করতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ অন্যথায় দেশে খুন, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি ও ধর্ষণের মতো বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যেতে পারে৷ এরই মধ্যে লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে৷
গত ১২ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের তখনকার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাত দিনের মধ্যে লুট হওয়া অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী সোমবারের (১৯ আগস্ট) মধ্যে অস্ত্র জমা না দিলে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হবে৷ তখন অস্ত্র পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ যদি জমা না দেন, তাহলে দুটি অপরাধ গণ্য হবে৷ একটি অবৈধ অস্ত্র, আরেকটি সরকারি নিষিদ্ধ অস্ত্র আপনাদের হাতে৷ আন্তর্জাতিক আদালতেও যাওয়া যেতে পারে৷ এই অস্ত্র তারা কোথায় পেল৷ যদি ভালো চান, তাহলে এই অস্ত্রগুলো ফেরত দিন, না হলে আমরা হান্টিং (খোঁজা) শুরু করব৷’
সরকারি সেই ঘোষণা অনুযায়ী, সোমবার ছিল অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন৷ যারা অস্ত্র জমা দেয়নি, তাদের গ্রেপ্তারে কি এখনই পুলিশ অভিযান শুরু করবে? ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ‘ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকার ৮০ ভাগ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হয়েছে৷ অনেকেই সেনাবাহিনীর কাছে, র্যাবের কাছে, আমাদের থানাগুলোতে, এমনকি ফায়ার সার্ভিসের কাছেও অস্ত্র জমা দিয়ে গেছেন৷ এখন আমাদের একটি তালিকা করতে হবে৷ এরপর উদ্ধার অভিযানের বিষয়৷ তবে এখনই আমরা অভিযানের কথা ভাবছি না৷ অভিযান শুরু করতে হলে আমাদের কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে৷’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অভিযানের ব্যাপারে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি৷ কেবল তো সময় শেষ হলো৷ ফলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ পাশাপাশি ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে এখনও নতুন কোনো নির্দেশনা আসেনি৷’
গত ৯ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটে৷ এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ, অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো৷’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে চারটি বাদে সব থানাই কম-বেশি আক্রান্ত হয়েছে৷ হামলা ঠেকাতে ও নিজেদের জীবন বাঁচাতে থানায় অবস্থান করা পুলিশ সদস্যরা ছুড়েছেন নির্বিচারে গুলি৷ এতে হতাহতও বেড়েছে৷ এসব হামলায় পুলিশেরও ৪৪ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন৷ এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ জন ও যাত্রাবাড়ী থানায় ১৭ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন৷ অন্যরা সংঘর্ষের সময় প্রাণ হারিয়েছেন৷
সম্প্রতি ফেনী মডেল থানা থেকে লুট হওয়া একটি পিস্তল বিক্রির সময় ধরা পড়েন মো. রুবেল (২৯) নামে এক যুবক৷ ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘১৪ আগস্ট রাতে ফেনী শহরের শাহীন একাডেমি এলাকায় এক ক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষির সময় পিস্তলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রুবেল৷ শুধু একটি নাইন এমএম পিস্তল নয়, রুবেলের কাছ থেকে ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিনও উদ্ধার করা হয়৷’
অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র জমা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা৷ লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি গ্যাসগান, চায়না রাইফেল, সিগন্যাল লাইট ও শোল্ডার সিগন্যাল লাইট ছিল৷ সলঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনের সময় হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানায় আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করে৷ ওই সময় কয়েকটি অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটে৷ অস্ত্রগুলোর মধ্যে দুটি রাস্তায় ভেঙে ফেলেন তারা৷ সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে কয়েকজন হাটিকুমরুল ইউনিয়নের পাঁচলিয়া এলাকার ইউপি সদস্য শাহ আলীর কাছে জমা রাখেন৷ অস্ত্রগুলো ইউপি সদস্য ও আন্দোলনে যুক্ত কামরুল হাসান এবং নাজমুল হাসানসহ কয়েকজন ছাত্র সলঙ্গা থানায় এসে জমা দেন৷’
এদিকে ফরিদপুরের সদরপুর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিয়ে তিন বন্ধু টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে ‘অসাবধানতাবশত’ গুলিবিদ্ধ হয়ে পলাশ হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়৷ গত ১২ আগস্ট ঢাকা নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পলাশ৷ গত ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন তিনি৷
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র সাধারণ মানুষ বা অপরাধীদের হাতে থাকা কতটা বিপজ্জনক জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র যে কারও কাছে থাকাই বিপজ্জনক৷ কারও কাছে অস্ত্র থাকলে তার মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে৷ এতে মানুষের শরীর ও জান-মালের ঝুঁকি থেকে যায়৷ এখন একটা পরিস্থিতির মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে অস্ত্র চলে গেছে৷ সরকার-ঘোষিত সময়ের মধ্যে যদি কেউ অস্ত্র জমা দিয়ে যান, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা ঠিক হবে না৷ আর কেউ যদি জমা না দেন, তাহলে অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলা আছে৷ তখন একটা অভিযান চালিয়ে এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে হবে৷ সেটা যত দ্রুত করা যায়, ততই ভালো৷’
পুলিশের আরেকজন সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বেসামরিক লোকের হাতে পুলিশের অস্ত্র থাকা তো ঠিক না৷ কিন্তু চাইলেই তো এখন অভিযান চালানো যাবে না৷ কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, সেটা তো বিশ্বে আর কোথাও ঘটেনি৷ ফলে পুলিশ মানসিকভাবে এখনও স্বাভাবিক জায়গায় যেতে পারেনি৷ এজন্য সময় লাগবে৷ আবার মুখে বললেই তো অভিযান হয় না, এর জন্য তথ্য-উপাত্ত লাগে৷ সেগুলোতো এখন পুলিশের কাছে নেই৷ ফলে অস্ত্র উদ্ধার যেমন জরুরি, তেমনি পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে কাজগুলো করতে হবে৷ তড়িঘড়ি করে কোনো কাজ করা ঠিক হবে না৷’