টিএসসি প্রাঙ্গণ যেন ত্রাণের এক মানবিক উৎসব!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমজাদ হোসেন। বয়স ৭০ থেকে ৭৫। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখে কথা নেই। তবে, উচ্ছ্বসিত। একের পর এক গাড়ি ঢুকছে সেখানে। সেই সব গাড়ি থেকে নামছে বস্তাভর্তি ত্রাণ। সব মিলিয়ে যেন ত্রাণের মহামানবিক উৎসব! আর সেটি দেখেই আনন্দাশ্রু বইছে আমজাদের চোখে। এনটিভি অনলাইনকে এমনটাই জানালেন ঢাবির এই সাবেক শিক্ষার্থী।
চোখ মুছতে মুছতে আমজাদ বলেন, ‘আমার এত বছরের জীবনে কখনও বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখিনি। আমি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমার এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আজ দেখছি নতুন এক বাংলাদেশ।’ বলতে বলতে ফের ফুঁপিয়ে ওঠেন তিনি। তরুণদের গণত্রাণ কর্মসূচির মহাযজ্ঞের অশিংদার সেও।
টিএসসির গেট জুড়ে সারি সারি গাড়ি
বন্যার্ত মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য আজ শনিবার (২৪ আগস্ট) টানা তৃতীয় দিনের মতো টিএসসি প্রাঙ্গণে গণত্রাণ সংগ্রহ করছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা। গত দুদিন ধরে এই ত্রাণ কর্মসূচি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তাই আজ তৃতীয় দিন এই কর্মযজ্ঞ বেড়েছে আরও বহুগুণ।
গেট জুড়ে একের পর এক গাড়ি ঢুকছে। কেউ নিয়ে আসছেন জামাকাপড়, কারও গাড়িতে শুকনা খাবার। কেউ আবার নিয়ে এসেছেন মেয়েদের স্যানেটারি ন্যাপকিন। এমনকি কম্বল, লুঙ্গি, বিছানার চাদর, বালিশ, তোষক আরও অনেক কিছু। এক এক করে গাড়ি প্রবেশ করছে আর গাড়ি থেকে নামছে বস্তাভর্তি এসব ত্রাণ। এ যেন ত্রাণের এক মানবিক উৎসব!
গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাচ্চাদের ডায়াপারের সংখ্যাটা কম ছিল। আজ সেই অভাবটা পূরণ হয়ে গেছে। গাড়িভর্তি ডায়াপার নিয়ে এসেছেন অনেকে। কেউ রিকশায়, কেউ ভ্যানে করে, কেউ আবার সিএনজি ভর্তি সামগ্রী নিয়ে হাজির হয়েছেন টিএসসির প্রাঙ্গণে।
ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম
গাড়ি থেকে গ্রহণ করা ত্রাণ একদল গেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আরেক দল সেগুলো হাতে নিয়ে পাস করছেন আরেকজনের হাতে। এভাবে পাস হতে হতে ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত বিশাল লাইন। একে অপরের হাতে পাস করে ত্রাণ ঢুকছে ক্যাফেটেরিয়াতে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত এই লাইনে পরিবর্তন করে হয়ে অংশ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরের চিত্র
ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরের চিত্রটা আরও সুশৃঙ্খল। একপাশে পানির বোতল সাজানো, একপাশ জুড়ে বাচ্চাদের খাদ্য, আরেকপাশে শুকনা খাবার, মোমবাতি-দিয়াশলাই, স্যানেটারি ন্যাপকিন, ডায়াপার, লাইফজ্যাকেট, মেডিসিনসহ আরও অনেক সামগ্রী।
ওষুধ রাখার কর্নারের দায়িত্বে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওষুধগুলো আলাদা করছেন তারা। প্যারাসিট্যামল, মন্টিলুকাস্ট, মেট্রোনিডাজলসহ নানা গ্রুপের ওষুধ আলাদা আলাদা করে প্যাকেট করছেন তারা।
আরেকদল শিক্ষার্থী বাচ্চাদের চিপস, বিস্কুট, কেক এসব আলাদা আলাদা প্যাকেট করছে। কেউ কেউ সেরেলাকসহ বাচ্চাদের দুধের প্যাকেট করছে। কেউ বা সাজাচ্ছেন চাল-ডালের প্যাকেট। একদল সাজাচ্ছে মোমবাতি, দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট।
মাঠের ভেতর আরেক কর্মযজ্ঞ
টিএসসিতে সবচেয়ে বেশি ত্রাণ এসেছে জামাকাপড়ের। এখানে শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয়, অনেক মানুষ কাজ করছেন। বস্তায় বস্তায় জামাকাপড় আসছে সেগুলো খুলে আলাদা আলাদা করে প্যাকেট করছেন অনেকে। মেয়েদের কাপড়, বাচ্চাদের কাপড়, পুরুষদের কাপড়—এমন তিনটি করে সেকশন করে দেওয়া হয়েছে। তিনটি সেকশনে কয়েকটি গ্রুপ বসে কাজ করছে।
আরেকটি বিভাগ ছিল ঘরোয়া সামগ্রী। কারণ, বিপুল পরিমাণে কাঁথা, কম্বল, বালিশও এসেছে। সেসবও গুছিয়ে প্যাকেট করছে কয়েকটি গ্রুপ। স্মৃতি নামের এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘সকাল ১০টায় এসেছি টিএসসিতে। অনেক জাম-কাপড় এসেছে। রোদের মধ্যে অনেকের কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সবাই মিলে বেশ উপভোগ করে কাজগুলো করছেন।’
আরেক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘এখানে অনেকেই আসছেন, তবে যারাই আসছেন সবাইকে বলব পর্যাপ্ত খাবার খেয়ে আসবেন। রোদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেকে অসুস্থবোধ করছে। তবে, এই কাজ আমরা মন থেকে করছি।’
রাকিব নামের এক ছাত্র বলেছেন, ‘আমরা এতটা সাড়া পাব চিন্তাও করতে পারিনি। আমার বিশ্বাস দ্রুতই আমরা এই বিপদ কাটিয়ে উঠব। ফেনী আবারও হাসবে। আমরা সবাই আছি বন্যার্তদের পাশে।’
নগদ অর্থ প্রদানের বুথ জুড়ে ব্যস্ততা
গতকাল শুক্রবার কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা জমা পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা ৷ আজও দেখা গেল নগদ অর্থ প্রদানের হিড়িক। প্লাস্টিকের যে ঝুড়িতে টাকা জমা পড়ছিল সেই ঝুড়ি একটু পরপরই খালি হচ্ছিল।
শিশু থেকে বৃদ্ধ ও নারীরা একের পর এক হাজির হন অর্থ নিয়ে। অনেক শিশুরা নিজেদের জমানো টাকা এনে দিয়েছেন ত্রাণ তহবিলে। ক্লাস ফোরে পড়া মুসকান বলেছে, ‘আমি ঈদ সালামি পেয়ে গত দুই বছর এই টাকাগুলো জমিয়েছি। আজ আমি এটা সবার সাথে ত্রাণের বাক্সে দিতে এসেছি।’
আরেক ছোট্ট শিশু জ্বর নিয়ে এসেছে নিজের ব্যাংক নিয়ে। তার জমানো টাকা নিজের হাতেই দান করে খুশি আত্মহারা ছয় বছরের শিশু। তার মাও জানালেন উচ্ছ্বাসের কথা, ‘সত্যিই এমন কার্যক্রমের অংশ হতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে। এই বাংলাদেশ দেখা স্বস্তির।’
অনেক নারীরাও নিজের জমানো টাকা নিয়ে হাজির হয়েছেন। একজন চিকিৎসক ৭৫ হাজার টাকার এক বান্ডেল দিয়ে বললেন, ‘এই ছাত্রছাত্রীদের কাজ দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ওদের কাছে আমাদেরও শেখা উচিত। ওরা আমাদের একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেবে। এভাবে সবাই এক হয়ে কাজ করলে কোনো বিপদই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’
এই চিকিৎসকের কথাটাই হয়তো হাজারও মানুষের হৃদয়ের কথা। শিক্ষার্থীদের এত পরিশ্রমে আবারও আশার আলো দেখবে বন্যার্তরা। সেই সঙ্গে ছাত্র-জনতার এই প্রচেষ্টাগুলোই হতো আগামীতে উপহার দেবে—এক নতুন বাংলাদেশের!