ধাওয়ায় পদত্যাগের রেকর্ড আউয়াল কমিশনের, নির্বাচনি প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নতুনেরা
চারিদিকে তখন নির্বাচনি উত্তাপ। যদিও ভোটের মাঠ এক পাক্ষিক। বিএনপিসহ তাদের সমমনাদের বর্জিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সেই মাঠে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনাদের দোঁড়ঝাপ। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ২০২৩-এর পাতা উল্টিয়ে আসে ২০২৪। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। দুর্দান্ত প্রতাপ দেখিয়ে বিএনপিসহ আওয়ামী বিরোধীদের গ্রেপ্তার, তাদের ওপর হামলা, মামলা করে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে রাখা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পায় ‘ডামি নির্বাচন’-এর খেতাব।
যদিও ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো নির্বাচন হয়েছে। আমি এতটা আশা করিনি।’
পরের দিন ইসি থেকে জানানো হয়, ৩০০ আসনের মধ্যে দুটি আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়েছে। ফলে ২৯৮টি আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যাক ২২২টি আসন লাভ করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্র পদে মোট ৬২টি আসনে জয়লাভ করেছেন প্রার্থীরা।
সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও তাদের সমমনারা তখন একেবারেই কোনঠাঁসা। নেতাকর্মীদের অনেকে তখন কারাগারে। এই যখন অবস্থা, তখন শুরু হয় ষষ্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ডামাডোল। ৮ মার্চ ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভোট পড়ে ৩৬ দশমিক এক শতাংশ। প্রথম ধাপের ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নির্বাচনি এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে। গত দেড় দশকের মধ্যে এ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার সর্বনিম্ন। সর্বশেষ গত ৫ জুন চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিত ৬০ উপজেলায় ভোট পড়ে ৩৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এভাবে মোট চার ধাপে দেশের সব উপজেলার ভোট সম্পন্ন করে ইসি। নির্বাচনি সামগ্রিক ফলাফল প্রায় একই ধরনের আসতে থাকে। সব উপজেলার ভোট শেষে সিইসি বলেছিলেন, ‘সব মিলিয়ে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ।’
পরের মাস জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকাসহ দেশের রাজপথ। ১৬ জুলাই রাজধানীসহ সারাদেশে ছয়জন হয় নিহত। তারপর থেকে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা। পহেলা আগস্ট এ আন্দোলন আর কেবল কোটা আন্দোলনে সীমাবন্ধ না থেকে সরকার পতনের এক দফায় গিয়ে গড়ায়। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হন বাধ্য। এরপর গঠিত হয় অর্ন্তবর্তী সরকার।
৫ আগস্টে পর জরুরি কাজ ছাড়া সে সময়ের নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচন ভবনে যেতেন না। সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ২৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিপ্লব ও ফরমান : সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামের এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে। আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছি।’
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নিলেও আড়াই বছরের মাথায় গত ৫ সেপ্টেম্বর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন আউয়াল কমিশন। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে আউয়াল কমিশন। এর আগে দায়িত্বকাল শেষ না হতে এভাবে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি কোনো কমিশনকে। সেদিন তারা ইসি সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে নির্বাচন ভবন ছাড়েন। নির্বাচন ভবন বের হয়ে যাওয়ার সময় বাইরে থাকা বিক্ষুব্ধ জনতা নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমানের গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ করে।
এরপর ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ঘোষণা দেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন গঠন করা হবে। এ কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। ৩ অক্টোবর তাকে কমিশন প্রধান করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
দীর্ঘদিন নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করা বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে এ কমিশনে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহেমদ, নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ডা. জাহেদ উর রহমান, শাসনপ্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ মীর নাদিয়া নিভিন, ইলেকট্রনিক ভোটিং ও ব্লকচেইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সাদেক ফেরদৌস। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছিল।
এরপর গত ৩১ অক্টোবর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম প্রস্তাব করতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি। সার্চ কমিটির দেওয়া নাম থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসিসহ চার কমিশনারের নাম চূড়ান্ত করে। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। এ ছাড়া কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তাহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ২৪ নভেম্বর এ কমিশন শপথ গ্রহণ করে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।
গত ৯ ডিসেম্বর এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছিলেন, আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময়ক্ষেপণ করছি না, করব না। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যখন সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিবে, তখন আমরা নির্বাচন করতে পারব। নির্বাচন করার জন্য আমরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখব, এবং সেটা চলছে। আমি কাউকে সাপোর্ট করার জন্য, প্রমোট করার জন্য এখানে আসিনি। একটা ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল ইলেকশন করার জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করব ইনশাল্লাহ। জনগণ বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেনি। আমরা জণগণের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাই। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা আরও দ্রুত গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারব।
দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে নির্বাচন কমিশনারা কাজ করে চলেছে। কাজ করে চলেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন মূলত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইন-বিধিগুলো পর্যালোচনা করে সরাসরি মতামত নেওয়া শুরু করে। সেজন্য, সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে বৈঠক করে এ কমিশন। পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাধারণ মানুষের মতামত নেয়। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও মেসেঞ্জার এবং ই-মেইলে এ মতামত নেয়। গত ২২ অক্টোবর থেকে এ মতামত নেওয়া শুরু করে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মতামত নেয় কমিশন।
প্রায় শেষ হয়ে এসেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাজ। দেশে প্রথমবারের মতো গঠিত এই কমিশনের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের শেষ সময় আগামী ৩১ ডিসেম্বর। প্রতিবেদনের সবশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে কমিশনপ্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ প্রতিবেদক। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, অংশীজন ও জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে এরই মধ্যে প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত। নির্ধারিত সময়েই সরকারের কাছে তা জমা দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি কমিশনের রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথকে মসৃণ করার দিকনির্দেশনামূলক নানা সুপারিশ থাকবে সেই প্রস্তাবনায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৪, ২০১৮ এ ২০২৪ সালের সমালোচিত জাতীয় নির্বাচনে কী কী প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা আমরা জানার চেষ্টা করেছি। জানা-বোঝার পর একটি ভালো নির্বাচনের জন্য যেসব বিষয়গুলো নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংযুক্ত করা দরকার মনে হয়েছে, আমরা আনার চেষ্টা করছি। সে হিসেবে আমরা আমাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি কাজ করছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ে আমরা সরকারের কাছে আমাদের প্রতিবেদন পেশ করতে পারব।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এ কমিশনের কার্যকাল শুরুর পর থেকে রোববার (২২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ওয়েবসাইটসহ ৫টি মাধ্যমে কমিশনের কাছে এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মতামত ও কমেন্ট দিয়েছেন এক হাজার ৮০৩টি। এ ছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অনেকের মতামত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের নিবন্ধিত ৪৮ দলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ ২২টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে লিখিত মতামত আহ্বান করে এ কমিশন। তবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বাকি ২৬টি দলের কাছে কোনো মতামত চাওয়া হয়নি।
বিভিন্ন মহল থেকে পাওয়া এসব মতামত বিচার-বিশ্লেষণ করেছে কমিশন। সেসব মতামতের মধ্যে থেকে ১৫টির মতো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে কমিশন। ইসির স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, নির্বাচন পদ্ধতি, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নারী আসন, ‘না’ ভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রবাসী ভোট, ইভিএম পদ্ধতি, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা সংশোধন ও হালনাগাদ, প্রার্থীদের হলফনামা ও নির্বাচনি ব্যয় প্রভৃতির মতো বিষয়গুলো আমলে নিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র, মনোনয়ন-বাণিজ্য, নির্বাচন পর্যবেক্ষণব্যবস্থা, নির্বাচনি অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের জবাবদিহি, দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ভূমিকাসহ নানা বিষয়ে মত ও পরামর্শ দিয়েছেন অংশীজনরা। এসব মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশমন।
সংস্কার কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কমিশন বিভিন্ন মাসুষের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে। সেখান থেকে যেটা ভালো মনে হয়েছে, সেটা গ্রহণ করছে। এ ছাড়া বিএনপি, জামায়াতসহ ২২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব নিয়েছে কমিশন। সেখান থেকে যে মতামত এসেছে, তাও আমলে নিয়েছে কমিশন। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে খুলনা, সিলেট ও রংপুরে বিভাগীয় সভা হয়েছে। এরপর সম্ভব হলে পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অন্যান্য বিভাগেও সভা করার পরিকল্পনা কমিশনের রয়েছে।