শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর পাঁচ মাস আজ
৫ আগস্ট ২০২৪। এক ভীষণ উত্তপ্ত দিন। ঐতিহাসিক দিনও বটে। এ দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ডাকা হয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সারা দেশের ছাত্র-জনতা ঢাকার সড়কে নেমে পড়ে।
উদ্দেশ্য গণভবন ঘেরাও। সকাল থেকে ঢাকার প্রতিটি প্রবেশমুখ দিয়ে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার স্রোত নামে গণভবনের দিকে। এমন স্রোত, যা কেউ আগে কখনও দেখেনি। ঢাকার রাজপথ ছাত্র-জনতার ঢলে পরিপূর্ণ।
এই যখন অবস্থা, তখনও হাসিনার পেটোয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, তারা বুঝতেও পারেনি একটু বাদেই কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু, থেমে থাকেনি ছাত্র-জনতা। পুলিশের গুলিকে উপেক্ষা করে গণভবনমুখী যাত্রা চলতে থাকে ছাত্র-জনতার। সেদিন সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সেনা সদস্যরা কোনো ছাত্র-জনতাকে বাধা দেয়নি। আবার ছাত্র-জনতাও সেনা সদস্যদের সহযোগিতা করছিল। এই যখন সড়কের অবস্থা, তার কিছুক্ষণ আগেই গণভবন ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। ছাত্র-জনতার বিপুল বিস্ময়কর স্রোত তখন গণভবনের দিকে ছুটে চলছিল।
৫ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকার মোড়ে মোড়ে বিজিবির চেকপোস্ট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আবার সেনাবাহিনীও সরকারের কথা শুনতে চায়নি। অর্থাৎ, ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে চায়নি। ফলে, তখন পলিয়ে যাওয়া ছিল শেখ হাসিনার হাতে একমাত্র বিকল্প।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার কুর্মিটোলা ঘাঁটি থেকে উড়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন সাবেক বাণিজ্যমেলার মাঠে অবতরণ করে। তখন গণভবন থেকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেখানে যান। হেলিকপ্টারটিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা উঠলে হেলিকপ্টারটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের পশ্চিমে অবস্থিত কুর্মিটোলা ঘাঁটিতে অবতরণ করে। তারপর হেলিকপ্টারটি ভারতের উদ্দেশে উড়াল দেয়। এভাবে সমাপ্তি ঘটে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের।
শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর উল্লাসে ফেটে পড়ে সারা দেশের নির্যাতিত, আন্দোলনরত জনতা। একইসঙ্গে কোণঠাসা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ তাদের সমমনারা।
আজ সেই ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের পাঁচ মাস পূর্তি। এখন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনারা হামলা ও খুনের মামলা নিয়ে কার্যত পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্র-জনতার সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাচ্ছে এবং আন্দোলনকারী ছাত্ররা রাষ্ট্র সংস্কারে মন দিয়েছে।
শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাকালের সাড়ে ১৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলেন স্বৈরশাসনের ভিত্তি। তিনি তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে আইন কিংবা নিয়মের ধার ধারেননি। তার যা মন চেয়েছে, তিনি তাই করেছেন। এর শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নির্বিচারে শুরু করেন বিরোধী দল ও মতকে দমন। এতে ব্যবহার করেন বিচার বিভাগকে। একইসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বল প্রয়োগ, মামলা, হামলা, গুম, হত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা ভোটে গদি টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে দিনের ভোট সেরে ফেলেন রাতেই। প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে করা ২০২৪ সালের নির্বাচন খ্যাতি পায় ‘ডামি নির্বাচন’ নামে। এভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবস্থান টিকিয়ে রাখা শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একগুঁয়েমি, বেপরোয়া, অহঙ্কারী; হয়ে উঠেন হিংস্র ‘ওয়ানম্যান আর্মি’। এই অহঙ্কারের আগুনে পুড়ে অবমূল্যায়িত হন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। যদিও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বেপরোয়া একগুঁয়েমিই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। সাত মাস পূর্তির আগেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। তবে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় কর্মীদের ব্যবহার, বাহিনীকে দিয়ে হত্যা-দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা আকড়ে পড়ে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তিনি, তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি!
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার হিংস্রতার বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়। গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় ‘গণহত্যার’ দুই অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।