অপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা : চিফ প্রসিকিউটর

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের যুক্তি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সকল রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। সকল বাহিনী, কেবিনেট সদস্য, পার্লামেন্টের সদস্য, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা।
যুক্তি তুলে ধরে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, দেশের প্রত্যেক অপরাধীদের মনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই তার প্রমোশন নিশ্চিত। তার কথা মতো অপরাধ করতে পারলেই ওপরে ওঠা যাবে, অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া যাবে। শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধীদের নিউক্লিয়াস, প্রাণভোমরা। এই নিউক্লিয়াস ভেঙে ফেলতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ রকম নিউক্লিয়াস হয়ে উঠতে না পারে।
টানা পাঁচদিন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আজ বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে এ আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
আগামী সোমবার শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ আবার শুনানি করবেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যুক্তিতে বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সকল অপরাধ বাস্তবায়নে পরিকল্পনাকারী ছিলেন। শেখ হাসিনার নির্দেশ আইজিপির কাছে পাঠাতেন। ১ হাজার ৪০০ মানুষ হত্যার দায়ে শেখ হাসিনার ১ হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। যেহেতু সেটা সম্ভব না তাই তাদের দুজনের চরম দণ্ড প্রার্থনা করছি। তাদের সম্পদ থেকে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আবেদন করছি।
শুনানির শুরুতে সাক্ষীদের বক্তব্য ও এনটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলের ডকুমেন্ট ফুটেজ আদালতে প্রদর্শন করা হয়। পরে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম অপরাধের বর্ণনা ও যুক্তি তুলে ধরে বলেন, জুলাই আন্দোলনে শিশুদেরকে হত্যার পর যখন জানানো হলো তখন শেখ হাসিনা বলল, তারা শিশু নয়। এভাবে হত্যাযজ্ঞকে তিনি বৈধতা দিয়ে হত্যাকারীকে উসকানি দিয়েছেন। সারাদেশে ১৪০০ মানুষকে হত্যা করা হলো। কয়েক হাজার মানুষ আহত ও চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে গেল, পঙ্গুত্ব বরণ করল। এদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আবার অনেকের একমাত্র সন্তান ছিলেন। এসব পরিবারগুলো কেউবা সন্তান কেউবা বাবা-মা কেউবা ভাই-বোন হারিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধান মোতাবেক এসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়েছে কিনা?
জবাবে প্রসিকিউটর বলেন, মাই লর্ড সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের প্রয়োজনীয় অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারি হাপাতালে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একই সাথে জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এককালীন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
এ সময় তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের বিধান মোতাবেক অপরাধীদের জব্দকৃত প্রপার্টি থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা দেওয়া যেতে পারে।
পঞ্চম দিনের যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এনটিভির ভিডিও ফুটেজসহ সাক্ষীদের সাক্ষ্য তুলে বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে বাহিনীগুলো মারণাস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা চালিয়েছে। হত্যাকে ধামাচাপা দিতে পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট চারবার পরিবর্তন করেছে।
অপরাধের বর্ননা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, লাশ পরিবারকে নিতে বাধা, পোস্ট মর্টেম ছাড়াই লাশ হস্তান্তর না করা, ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন করতে না দেওয়াসহ ওয়াইডস্প্রেড করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। পুরো বাহিনীকে নামানো, হেলিকপ্টার ব্যবহার, ড্রোন ব্যবহার, অতিরিক্ত বাহিনী হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহার করা হয়েছে। আজীবন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মুল করতে রাষ্ট্রীয় সকল জনশক্তি, রাষ্ট্রীয় সকল সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০৪১ কে ভিশন হিসেবে ধরে আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ থাকবে না- এ পরিকল্পনা করা হয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় দেখা গেল পুলিশ, ডিবি, র্যাব, আনসার, বিজিবি এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। পাঁচ বছরের শিশু, দশ বছরের শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ। যাত্রাবাড়িতে তাইমুর ভুইয়া তার বন্ধুকে সরানোর জন্য চেষ্টা করেছে সেখানে তাকে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দেওয়া হয়। যেসব ছাত্ররা স্লোগান দিয়েছিল তাদেরকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনী যখন মাঠে এসে দেখল নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। তখন সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। দেখা গেলো সেনাবাহিনী যখন গুলি না চালানোর সিদ্বান্ত নেয় তখন মানুষ সেনাবাহিনীকে চুমু খাচ্ছে, ফুল দিচ্ছে, পায়ে ধরে সালাম করছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, কামাল ও তাপসের সাথে শেখ হাসিনার ফোনে কথা হয় মারণাস্ত্র ব্যবহার, হত্যার সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয়। হাসপাতালে গিয়ে শেখ হাসিনা ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ নির্দেশ দিয়ে অপরাধজনক মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটায়। গণত্যার পরও তার মধ্যে এক মিনিটের জন্যও কোনো অনুশোচনা নেই। ভারতে বসে এখনো উসকানি দিচ্ছেন। হত্যার নির্দেশ দিচ্ছেন। সুতরাং গত ১৫ বছরে দেশে যত গুম-খুন, জুলাই আন্দোলনে যেসব হত্যা ও মানবাধিকার লংঘন হয়েছে তার পুরো দায় শেখ হাসিনার। সারা দেশে সকল বাহিনী, কেবিনেট সদস্য, পার্লামেন্টের সদস্য, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা।
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর শেখ হাসিনার আনন্দ উৎসব সংবলিত বই ও আমার ফাঁসি চাই বইয়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরে মানুষকে হত্যার পর তার সেই নাচ ও খাওয়াদাওয়া বেশি করার প্রবণতার কথা তুলে ধরেন। মানসিকভাবে এ অপরাধী ছিল হত্যাকারী। সুতরাং এ অপরাধীর এসব অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি রয়েছে মৃত্যুদণ্ড। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। একজন মানুষকে হত্যার জন্য যদি একবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ১৪০০ মানুষকে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার ফাঁসি দিতে হবে। কিন্তু আইনে এটা সম্ভব নয়। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমরা তার চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করছি। যদি তাকে এ দণ্ড দেওয়া হয় তাহলে ন্যায়বিচার পাবে দেশের জনগণ। অপরাধ বিবেচনায় তাকে কোনো প্রকার অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ এ আইনে নেই।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে আসাদুজ্জামানও কোনো প্রকার অনুকম্পা পাওয়ার যোগ্য নয়। এ ছাড়া তাদের সম্পদ থেকে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আবেদন করছি। এ পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, এটাই আমাদের আরগুমেন্ট।