জুলাই ঘোষণাপত্র-নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে রাজনীতিতে তোড়জোড়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পাঁচ মাস পূর্ণ হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর ঘটনাবহুল সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করে সংস্কার কাজ চলছে। এদিকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলই দ্রুত সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ এর শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যে শঙ্কা, উদ্বেগ ও কখনো কখনো ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র নিয়েও ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনীতির মাঠে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে নানা সমীকরণ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি নাম দিয়ে নতুন দল গঠনের কার্যক্রম চলছে বেশ জোরেশোরেই। শিগগিরই নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে বিএনপির পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষনেতারা। তারা মনে করছেন, যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। দেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে কাকে গ্রহণ করবে, কাকে করবে না। জনগণের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল গঠন সবসময়ই ইতিবাচক। তবে অন্য দলগুলোর কেউ কেউ এতে ষড়যন্ত্র দেখছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সূত্র জানায়, বিএনপি চারটি মৌলিক বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, ৭২ এর সংবিধান বাতিল ও তড়িঘড়ি করে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ।
এদিকে সম্পতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির কয়েকটি প্ল্যাকার্ডের ‘স্লোগান’ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজন তৈরি করছে বলে মনে করছেন অনেকে। এসব প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়— ‘কাদের-মির্জা ভাই ভাই, বাংলাদেশে শান্তি চাই’, ‘ভোট ভোট করে যারা, লুটপাটে ব্যস্ত তারা’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির অন্যতম সদস্য জয়নাল আবেদীন শিশির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ ধরনের বিষয়ে আমাদের সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। কিছু অতি উৎসাহী নেতাকর্মী এ ধরনের প্ল্যাকার্ড নিয়ে গিয়েছিল।’
জয়নাল আবেদীন শিশির আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে। খুব শিগগিরই এর ঘোষণা আসবে।’
নতুন রাজনৈতিক দল প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থানে বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই। দেশের প্রয়োজনে আরও নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটবে, এটাই গণতন্ত্রের রীতি। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য না দিলেও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো দল গঠন হলে তা হবে কিংস পার্টি।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন হওয়ার ফলে জুলাই অভ্যুত্থান তৈরি হয়েছে। একটা কোনো বিপ্লব নয়, এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।
সাইফুল হক আরও বলেন, ‘এখনও ঝুঁকি রয়ে গেছে, আমরা নিরাপদ নই। অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকতে চাইলে বহু ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। যে কেউ রাজনৈতিক দল করতে পারে, তবে সরকারের ছত্রছায়ায় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন হলে, তা হবে কিংস পার্টি।’
দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়ে সাইফুল হক বলেন, ‘দ্রুত সংস্কারের ব্যাপারে বোঝাপড়া তৈরি করে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথনকশা ঘোষণা করা দরকার। কারণ, অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকতে চাইলে বহু ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল ও জনগণের নজিরবিহীন সমর্থন থাকা সত্বেও সরকারের ওপর মানুষের আস্থা ও ভরসায় চিড় ধরছে। মনে হয় সরকারও রাজনৈতিক দলকে কিছুটা এড়িয়ে চলছে। দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের এই দূরত্ব কমিয়ে আনা দরকার।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা বলেন, ‘সফল হতে চাইলে সরকারকে তার এজেন্ডা কমিয়ে এনে কাজের তালিকা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়, কিন্তু সরকারকে এই সহযোগিতা নিতে জানতে হবে।’
গত শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে জানানো হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র স্থগিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘এটা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেগুলো আমরা সমাধান করতে পেরেছি।’
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করেছিলাম, সব পক্ষ যেন অংশগ্রহণের সুযোগ পান। সবাই যেন তাদের ভাষা প্রকাশ করতে পারেন। ৫ আগস্ট যেভাবে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল তাদের ভাষা যেন ঘোষণাপত্রে থাকে। তাদের ন্যায্য যে অধিকার রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করেছেন, তাদের ভাষা যেন ঘোষণাপত্রে থাকে, সেটি নিশ্চিতে আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেছি।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন আরও বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একযোগে জনসংযোগ, লিফলেট বিতরণসহ প্রান্তিক জনগণের কাছে প্রচার-প্রচারণা চালাবে।’