আলোর পথিক ৪৫ সন্তানের জননী হাজেরা বেগম

ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রতিদিন ঘুম ভাঙে হাজেরা বেগমের। নিজের ব্যক্তিগত কাজ সেরে সন্তানদের নিয়ে আনন্দের সঙ্গে নেমে পড়েন এক যুদ্ধে। কাউকে মাদ্রাসায়, কাউকে স্কুলে, কেউ আবার যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন-দুজন নয়, হাজেরা বেগমের সন্তানের সংখ্যা ৪৫ জন! গর্ভে না ধরেও এদের সবার ‘মা’ হাজেরা বেগম।
হাজেরা বেগমের এসব সন্তানের বেশিরভাগই এসেছে যৌনপল্লি থেকে। হাজেরা বেগম নিজেও একসময় যৌনকর্মী ছিলেন। এনটিভি অনলাইনের বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে এবারের বিশেষ আয়োজনে থাকছে যৌনকর্মী থেকে ৪৫ সন্তানের মা হওয়া হাজেরা বেগমের সংগ্রামী জীবনের গল্প।
হাজেরা বেগমের জন্ম ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতার বছরে জন্ম নিলেও হাজেরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেননি। সৎমার অত্যাচারে আট বা নয় বছর বয়সেই তাকে ঘর ছাড়তে হয়। এরপর থেকে হাজেরা পথে পথেই বড় হয়েছেন। শুরুতে পকেটমার, পরে সরকারের আশ্রয়কেন্দ্র এবং সেখান থেকে পালানোর পর শেষ পর্যন্ত শিশু বয়সেই হাজেরা জড়িয়ে যান যৌন পেশায়। এ পেশার লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা তিনি হারে হারে টের পান। একসময় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমে আওতায় আসেন।
২০০০ সালের দিকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমের আওতায় গঠিত হয় ঢাকার পথে থাকা যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘ। হাজেরা প্রথম কাজ শুরু করেন যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত দুর্জয় শিশু নিবাসে।
২০০৮ সালে নিবাসটির জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলেও হাজেরা বেগমের তার জমানো টাকা এবং বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে প্রায় আড়াই বছর এই শিশুদের দেখভাল করতে থাকেন। কিছু ঝামেলা হলে পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যাঁরা দুর্জয়ের শিশুদের সহায়তা করতেন, তাঁদের সহায়তাসহ বিভিন্ন জনের সহায়তা নিয়ে হাজেরা ২০১০ সালে সাভারে ২৫ শিশু নিয়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠন শুরু করেন। রাজধানীতে স্থানান্তরের পর সময়ের ব্যবধানে তার সন্তানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ জনে।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় চলে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠন। এটার প্রেসিডেন্ট হাজেরা বেগম। সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। সংগঠনটি সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধন করা।
হাজেরা চান না, একটি শিশুও যেন শিশু অবস্থায় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়। তিনি ভালো করেই জানেন, একটি শিশুর জন্য পথে বড় হওয়া কতটা কষ্টের ও যন্ত্রণার। তবে ৪৫ জন সন্তানের দেখভাল করা এতটাও সহজ কথা নয়। তবে হাজেরার মমতা, বুকভরা ভালোবাসা, আঁচলজুড়ে অপত্য স্নেহ যেন সবই সহজ করে দিচ্ছে।
জানতে চাইলে হাজেরা বেগম বলেন, ৪৫ জনের মধ্যে চার-পাঁচজন শিশুর মা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেন। আর অন্যদের মায়ের পেশা যৌনকর্ম। তাঁদের জীবন কাটে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায়। সন্তানকে একটু নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্যই মায়েরা নিজের সন্তানকে হাজেরা বেগমের কাছে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন।
হাজেরা বেগম আরও বলেন, এমন সন্তান এখানে রয়েছে যাদের দিয়ে যাওয়ার পর আর কখনো কেউ খবর নিতেও আসেনি। আবার এমনও আছে যার মা রাস্তায় অপঘাতে মারা গেছে।
তিন সন্তান রেখে এক যৌনকর্মী মা কাজের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন, সেখানেই তিনি মারা যান, এই তিন শিশুকেও দেখভালের কথাও জানান হাজেরা।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমার এখানে জন্মের তিন ঘণ্টা মধ্যে আসা শিশুও আছে। ওর মা জন্ম দেওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমারে দিয়া চইল্যা গেছে, এই বাচ্চা মায়ের বুকের দুধও খাইতে পারে নাই।’
আরেকজন এসেছিল ৯ মাস বয়সে। তার মা নেশা করত, পথেই মরে যায়। এই শিশু মরা মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশ হয়। এমনই নানা বয়সের শিশু আছে এখানে। হাজেরা বলেন, আড়াই বছর থেকে শুরু করে বেশ বড় শিশুও আছে। বড় শিশুরা ছোটদের সামলে রাখে। মাঝেমধ্যে আবার নিজেদের মধ্যে মারামারিও করে তারা। আবার ঠিকও হয়ে যায়।
হাজেরা জানান, তার কাছে বেড়ে ওঠা এক সন্তান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) পড়াশোনা করছেন, আরেকজন আছেন মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজে। কয়েকজন কয়েকটি বড় কলেজে পড়ছেন বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া ছোটরা স্কুলে, মাদ্রাসাও অনেকে পড়েন বলে জানান তিনি। শুধু কী তাই, হাজেরার ছেলে-মেয়েরা নাচ-গানেও সমান তালে চর্চা করেন।
হাজেরা আরও জানান, বড় হওয়ার পর কোনো কোনো মা সন্তানকে নিয়ে যান, তবে এখন পর্যন্ত এখানে বড় হওয়া কোনো মেয়ে যৌন পেশা বেছে নিয়েছে, সে খবর পাওয়া যায়নি। পোশাকশিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন কাজ করছে তারা। ছেলেরাও বিভিন্ন কাজ করছে।
পড়াশোনার সময় স্কুলে ভর্তিতে কোনো সমস্যা হয় কি না, জানতে চাইলে হাজেরা বেগম বলেন, আগের চেয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসায় এখন অনেক স্কুল নিজেরাই এই ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করতে চাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা যে স্কুলে পড়ছে, সেই স্কুল কর্তৃপক্ষও এই ছেলে-মেয়েদের পরিচয় জানে।
হাজেরা বেগমের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তাদের জন্মদাত্রী মায়ের পেশা সম্পর্কে জানে। মা দেখতে এলে কেউ যাতে মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে, তা-ও সন্তানদের শেখান হাজেরা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি ওদের বলছি, তোমাদের মা তোমাদের ভালো চান বলেই তো এইখানে রেখে গেছে। তা না হইলে পথে থাকলে তো চোর-বাটপার হতে। এখন খাইতে-পড়তে পারছো।’
ছেলেমেয়েদের তিন বেলা খাবার, পড়াশোনা, খরচ কীভাবে আসে জানতে চাইলে হাজেরা খাতুন বলেন, দেশের বাইরে থাকা কয়েকজন বছরে কিছু নিয়মিত টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। কিছু পারিবারিক ট্রাস্ট, ব্যক্তি উদ্যোগের সহায়তাতেই চলছে সংগঠনটি। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেমেয়েরা শুরুতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তাঁরা এখন বড় চাকরি করে। তাঁদের সেই সহায়তার হাত অব্যাহত আছে, কেউ কেউ সংগঠনের কমিটিরও সদস্য। আর মেডিকেল পড়ুয়া কিছু ছেলে-মেয়ে স্বাস্থ্য ক্যাম্প বা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এই শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে।

হাজেরা বেগম বলেন, দেশের বৃত্তবানেরা যদি হাত বাড়ায়, এই কয়টা ছেলে-মেয়ের জীবন পাল্টে যেতে পারে।
আপনার নিজের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই—এ প্রশ্নে হাজেরা বেগমের উত্তর, ‘আমার এতগুলান সন্তান, নিজের আবার আলাদা কইরা থাকনের দরকার কী?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার একটাই স্বপ্ন এই শিশুদের জন্য জমি কিনে একটি বাড়ি বানানো। এই শিশুদের জন্য একটি স্কুল হবে, কলেজ হবে। এই শিশুদের মায়েরা বয়স্ক হয়ে গেলে যখন আর যৌনপেশায় থাকতে পারবেন না, তাঁদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রমও থাকবে।’
বর্তমানে যারা যৌনকর্মী রয়েছেন কিন্তু ফিরতে চান, তাদের বিষয় হাজেরা বলেন, ‘ফিরতে দুইটা জিনিস দরকার। এক হলো সাহস, অপরটি সামাজিক সহায়তা। আমি বলব, আমাদের সামাজিক অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। যার দরুন অনেকে ফিরে আসতে চাইলেও ফিরতে পারে না।’