গণমাধ্যম স্বাধীন হলে গুজব ছড়াবে কম : ইসিকে সাংবাদিকরা

গণমাধ্যম স্বাধীন না থাকলে এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে আগামী সংসদ নির্বাচন কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকরা। এ সময় সাংবাদিকরা জানান, গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিলে ভোটকে কেন্দ্র করে গুজব ডালপালা মেলতে পারে না।
আজ সোমবার (৬ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন।
চ্যানেল আইয়ের চিফ নিউজ এডিটর (সিএনই) জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, সঠিক তথ্য দ্রুত প্রকাশ করা গেলে গুজব কমবে। তাই ইসি যত দ্রুত ফলাফল দেবে, তত দ্রুত আমরা প্রচার করতে পারব।
জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কারণ নির্বাচনে এগুলোর অপব্যবহার দেখা যায়।
দীপ্ত টিভির সিএনই এস এম আকাশ বলেন, গুজব রুখতে মিডিয়াকে অবাধ করে দিতে হবে। মিডিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনাদের অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এজন্য নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এআই মোকাবিলায় ফ্যাক্ট চেকিং টিম গঠন করা যেতে পারে। এটা আমাদের দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রচার করতে পারি। এভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিল করা যাবে।
সময় টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জনি বলেন, গুজব তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে কমিশনকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তখনই সঠিক তথ্য জানাতে হবে। সেটা কমিশনকে সঙ্গে সঙ্গে মূল ধারার গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করতে হবে।
সংলাপে অংশ নিয়ে একাত্তর টিভির বার্তা প্রধান শফিক আহমেদ বলেন, সিইসি ও কমিশনারদের মর্যাদা মন্ত্রীর ওপরে রাখতে হবে। প্রশাসনের বদলে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত। বিনা ভোটের প্রার্থী নির্বাচন ঠেকাতে একক প্রার্থীর আসনে পুনঃভোটের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই সাংবাদিক বলেন, গণমাধ্যমে ভোটের খবর সংগ্রহে নীতিমালা সহায়ক নয়। এতে কারচুপির সঙ্গে জড়িতদের ধরতে পারি না। তাই সহায়ক নীতিমালা তৈরি ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
যমুনা টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের দায়-দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে। মাঠের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে, তারা ভোটের পর ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়তে পারেন—এমন ধারণা পরিবর্তন করতে হবে।
তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভোটকে আমরা যুদ্ধ না, উৎসব হিসেবে দেখতে চাই। কিন্তু বাস্তবে মাঠ নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে সাফল্য আসবে না।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক মোস্তফা আকমল বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার। এক মিনিটেই ভুয়া ছবি তৈরি করা যায়, প্রার্থীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা সম্ভব। তিনি ভোটার তালিকা হালনাগাদে ত্রুটি দূর করা ও ফলাফল দ্রুত প্রকাশের আহ্বান জানান।
গ্লোবাল টিভির সিএনই ফেরদৌস মামুন বলেন, ৫ আগস্টের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা কমেছে। মূলধারার গণমাধ্যম নয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মই গুজবের বড় উৎস—এটা ঠেকাতে ইসিকে কাঠামো তৈরি করতে হবে।
ডিবিসি টিভির সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, সংস্কার কমিশন অনেক কাজ এগিয়ে দিয়েছে। এজন্য আপনারা অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ দেরি করছেন। কিন্তু আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, সেগুলো আমলে না নিয়েই যদি নীতিমালা করেন, তাহলে তো আজকের এই সংলাপ ফলপ্রসূ হলো না। কাজেই নীতিমালা সংশোধন করা উচিত।
এই সাংবাদিক বলেন, অভ্যুত্থানের পর মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। সেটা করতে পারবেন কিনা, এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আপনারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন, আমরা ভুল-ত্রুটি ধরার চেষ্টা করব। কিন্তু সেটা আপনাদের আমলে নিতে হবে। আমরা অতীতেও দেখেছি গণমাধ্যমে প্রতিপক্ষ ভাবা হয়। তাই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারবেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন যদি আমলে নিয়ে প্রতিপক্ষ ভাবেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
জাহিদ নেওয়াজ খান আরও বলেন, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য গোপন করা হয়, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। হলফনামা যেটা দিল আমরা জানি ভুয়া, কিন্তু ইসি আর সেটা তদন্ত করে দেখল না, সেটা হলে তো আর হলফনামা দেওয়ার দরকার নেই। স্যোশাল মিডিয়ার বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এটিএন নিউজের হেড অব ইনপুট শহিদুল আজম বলেন, নিবন্ধিত গণমাধ্যম নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু ইউটিউব বা মোবাইলভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে খবর ছড়ানো ঠেকানো কঠিন। তাই ইসির তথ্য শাখাকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, যা চাপিয়ে রাখা যাবে না, সেটি উন্মুক্ত করাই ভালো। তাহলে সন্দেহ থাকবে না।
জিটিভির বার্তা প্রধান গাউসুল আজম বিপু বলেন, ফ্যাসিবাদী সময়ে নির্বাচনি কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। তিনি বলেন, রাতের ভোটে যারা সিল মেরেছিল তারা সরকারি কর্মকর্তা—তাদের পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হলে আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
নিউজ২৪এর হেড অব নিউজ শরিফুল ইসলাম খান বলেন, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। ভোট মানেই এক সময় ফ্যাস্টিভ মুভ ছিল। ধীরে ধীরে এটা রক্তক্ষয়ী অবস্থায় চলে আসছে। শুধু কাগজ দিয়ে, আইন দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। অন্যথায়, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক হবে গণমাধ্যমের এমন স্বাধীনতা দিতে হবে। এতে ইসিরও লক্ষ্য পূরণ সহজ হবে।
বৈশাখী টিভির বার্তা প্রধান কবির সুমন বলেন, নির্বাচনের ফলাফল পেতে যদি আমাদের দেরি হয়, তাহলে আমাদের গুজব ডালপালা বাড়তে পারে। তাই আমার সুনির্দিষ্ট দাবি, যারা জনসংযোগের দায়িত্বে আছেন তারা কোনো সেল করে দিতে পারেন কিনা। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে যারা হেড অব নিউজ আছেন তারা নির্বাচনের সাত দিন আগে কোনো হোয়াটসঅ্যাপ বা কোনো গ্রুপ করে দিতে পারেন কিনা, যেখানে তারা কোনো ইনফরমেশন দেবেন বা আমাদের কোনো ইনফরমেশন দেওয়ার থাকলে দেব।
বিটিভির বার্তা সম্পাদক মঈনুল ইসলাম বলেন, আপনাদের নির্দেশনায় কাজ করব। সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারিতে রাখতে হবে। ফেক নিউজ ছড়াবে। দ্রুত আমাদের চিহ্নিত করে জানাবেন, যাতে আমরা কাউন্টার করতে পারি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা, স্টার নিউজের হেড অব নিউজ ওয়ালিউর রহমান মিরাজ, মাছরাঙ্গা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি নিয়াজ মোর্শেদ, আনন্দ টিভির নিউজ ইনচার্জ জয়নাল আবেদীন, এটিএন বাংলার চিফ রিপোর্টার একরামুল হক সায়েম সংলাপে অংশ নেন।