জুলাই সনদ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যা রয়েছে

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু বিষয় উপস্থাপন করা হয়। সনদের ১৬ নম্বর তালিকায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়টি এখানে তুলে ধরা হলো:
সংবিধান সংশোধন করে নিম্নরূপ বিধান সংযুক্ত করা হবে-
(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
(২) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮খ সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ (পনেরো) দিন পূর্বে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ (পনেরো) দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ (ত্রিশ) দিন পূর্বে আইনসভার নিম্নকক্ষের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় (১) প্রধানমন্ত্রী, (২) বিরোধীদলীয় নেতা, (৩) স্পিকার, (৪) ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং (৫) সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট ৫ (পাঁচ) সদস্য সমন্বয়ে একটি 'নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি' গঠিত হবে। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদের স্পিকার সভাপতিত্ব করবেন।
(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের নিকট হতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮গ (৭)-এ বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল ১ (এক) জন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ১ (এক) জন মাত্র ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন।
(৫) রাজনৈতিক দলসমূহ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যগণ পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবে। কমিটি নিজ উদ্যোগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির নাম অনুসন্ধান ও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
(৬) পরবর্তী ৭২ (বাহাত্তর) ঘন্টার মধ্যে কমিটির সদস্যগণ সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিকট হতে প্রস্তাবিত নামসমূহ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(৭)-এর অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
(৭) বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ (একশত কুড়ি) ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ (আটচল্লিশ) ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য অনুচ্ছেদ ৫৮গ-এ বর্ণিত শর্ত অনুসরণপূর্বক সংসদের সরকারি দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। এছাড়া, সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল ২ (দুই) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে। উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত নামসমূহ স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।
(৮) উপর্যুক্ত দফা (৭)-এ বর্ণিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ৪৮ (আটচল্লিশ) ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল/জোটের প্রস্তাবিত ৫ (পাঁচ) জন ব্যক্তির নামের তালিকা হতে প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে; অনুরূপভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত ৫ (পাঁচ) জন ব্যক্তির নামের তালিকা হতে সরকারি দল যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রস্তাবিত মোট ২ (দুই) জনের নামের তালিকা হতে সরকারি দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নিবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নামসমূহের মধ্য হতে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হবেন। অথবা কোনো একজনের ব্যাপারে কমিটির ৫ (পাঁচ) জন সদস্যের মধ্যে যদি ৪ (চার) জন সদস্য একমত হন তাহলে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।
(৯) যদি উপর্যুক্ত পদ্ধতিতে কোনো একজনের বিষয়ে প্রস্তাবকারী পক্ষসমূহ একমত হতে না পারে তাহলে পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগের দুইজন প্রতিনিধি বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন; তবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করতে পারবেন না। উক্ত দুইজন প্রতিনিধির মধ্যে ১ (এক) জন আপীল বিভাগের বিচারপতি হবেন এবং ১ (এক) জন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হবেন। উক্ত ২ (দুই) জন বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধিকে মনোনীত করার জন্য- (১) সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, (২) কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং (৩) আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সমন্বয়ে ৩ (তিন) সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে।
(১০) এই পর্যায়ে ৭ (সাত) সদস্য বিশিষ্ট উক্ত বাছাই কমিটির সদস্যগণ পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে গোপন ব্যালটে 'র্যাংকড চয়েজ' (Ranked Choice) বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে উক্ত সংক্ষিপ্ত তালিকা হতে যেকোনো ১ (এক) জনকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবেন।
(১১) উপর্যুক্ত যেকোনো পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করবেন না।
(১২) উপযুক্ত পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে; তবে শর্ত থাকে যে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না।
(১৩) কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে অথবা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে পরবর্তী স্থানে থাকা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হবেন। এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন হলেও উপদেষ্টা পরিষদ বহাল থাকবে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পদ শূন্য হলে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা সেই শূন্য পদ পূরণের অধিকার রাখবেন।
(১৪) নিয়োগলাভের পর প্রধান উপদেষ্টা উপযুক্ত বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮%(৭)-এ বর্ণিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য হতে অনধিক ১৫ (পনেরো) জন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য বেছে নিবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ প্রদান করবেন।
(১৫) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে, ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে 'নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি' গঠিত হবে এবং উক্ত কমিটি পরবর্তী ১৪ (চৌদ্দ) দিন তথা ৩৩৬ (তিনশত ছত্রিশ) ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ অভিন্ন পদ্ধতিতে ১ (এক) জন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবে এবং তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন।
(১৬) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(৭) (ঘ) সংশোধনপূর্বক "বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন" শব্দসমূহের পরিবর্তে "পঁচাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন" শব্দসমূহ প্রতিস্থাপিত হবে।
(১৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং উপদেষ্টাগণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
(১৮) সংবিধানে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য, এখতিয়ার ও অবসানের সময়সীমা নির্ধারিত হবে।
(১৯) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৯০ (নবাই) দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
(২০) নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তার পদের কার্যভার গ্রহণ করবেন সেই তারিখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।
(২১) ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮গ (২)-এর বিধানে উল্লিখিত ব্যবস্থা বহাল থাকবে।