সোনালী ধানের শীষে নবান্নের জৌলুস হারানোর নীরব কান্না
এক সময় অগ্রহায়ণ মাস এলেই গ্রামবাংলার উঠোনজুড়ে শুরু হতো নবান্নের উৎসব। নতুন ধানের ঘ্রাণে ভরে যেত ঘর-বাড়ি, গানে-নাচে মাতিয়ে তুলত পুরো গ্রাম। কিন্তু সেই চিরচেনা উৎসবের ছবি এখন কেবল স্মৃতির পাতায়— এমনই আক্ষেপ মানিকগঞ্জের কৃষক–কৃষাণিদের।
জেলার সদর ও সাটুরিয়া এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে— আগের মতো আর নেই নবান্নের সেই চিরন্তন আনন্দ। নতুন ধান উঠলেও উৎসবের সেই রং নেই, মিলনমেলার উচ্ছ্বাস নেই। কৃষকদের একটাই অভিযোগ- ‘আগের মতো মানুষ আর নবান্ন মানে না, সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম্য উৎসবগুলো।’
সদর উপজেলার পাঞ্জনখাড়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক হযরত আলী জানান, ‘নতুন ধান উঠলে আমরা পাড়াপড়শি সবাই মিলে পিঠা বানাতাম, ঢোল-করতালে হইহই করত গ্রামের মানুষ। এখন সবাই ব্যস্ত, কেউ সময় পায় না। নবান্ন যেন উৎসব নয়, শুধু পুরোনো দিনের গল্প।’
কৃষাণি রওশন আরা বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা শহরে থাকে, কাজের চাপ বেশি। আগের মতো সবাই একসঙ্গে হয় না। তাই নবান্নের আনন্দ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।’
সাটুরিয়া উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের ধানের মাঠে পল্লী বধু রাশেদা বেগমের পরিশ্রম যেন নবান্নের আনন্দকে গভীর করে তোলে। পা দিয়ে ধান মাড়াইয়ের প্রতিটি ধাপে তিনি শুনিয়ে দেন নতুন ফসলের আগমনি সুর। রোদের আলোয় ঝিলমিল করে ওঠা ধানের স্তূপে গ্রামবাংলার পুরনো উৎসব— নবান্নের গন্ধ মেখে থাকে। নবান্ন মানেই কৃষকের ঘরে নতুন ধানের সুবাস, আর সেই সুবাস ছড়াতে এমন নিঃশব্দ মহাসমর লড়ে যান রাশেদার মতো হাজারো নারীরা— যাদের হাতেই জন্ম নেয় গ্রামবাংলার সোনালি সমৃদ্ধি।
আরও পড়ুন : নবান্ন : অসাম্প্রদায়িক লোক উৎসব
কান্দাপাড়া গ্রামের কৃষক সালাউদ্দিন, হযরত আলী ও নিমাই মালাকারের ধান কাটার মৌসুমে সোনালি বিকেলের এই দৃশ্য যেন গ্রামবাংলার জীবন্ত উৎসব। কৃষকের হাতে দোল খাওয়া ধানের আঁটি— প্রতিটি শীষে জমেছে বছরের পরিশ্রম, আশার আলো আর নবান্নের আনন্দ। ধান মাড়াইয়ের শব্দে ভরে উঠেছে মাঠ, আর কৃষকের ঘামে লেখা হচ্ছে নতুন ফসলের গল্প।
হারপাটের টানে সোনালি ধান ছড়িয়ে পড়ে মাঠজুড়ে, আর সেই সুরে বাজে গ্রামবাংলার প্রাচীন নবান্নের স্বরলিপি। হামিদা বেগমের ভাষায়, ‘ধান উঠলে শুধু খাদ্য নয়— একটা শান্তি, একটা তৃপ্তি ঘরে ফেরে।’
স্থানীয়রা বলছেন, আধুনিকতা, কর্মব্যস্ততা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এই ঐতিহ্য ম্লান হওয়ার প্রধান কারণ। আগে যেখানে উঠোনে নতুন ধান শুকানোর দৃশ্য ছিল নিয়মিত, এখন সেখানে চাষাবাদ কমেছে— যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে, মানুষের মিলন কমেছে।
আরও পড়ুন : বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ
তবে সবকিছুর পরেও কৃষকদের প্রত্যাশা— এই ঐতিহ্য যেন আবার ফিরুক। নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ আর সামাজিক উদ্যোগ বাড়লেই নবান্ন উৎসব আবারও ফিরে পেতে পারে তার আসল রূপ। বাংলার মাটি, মানুষের হাসি আর নতুন ধানের গন্ধে জেগে ওঠা এই উৎসব তাই আজ শুধু একটি স্মৃতি নয়— এটি হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ সংস্কৃতির এক নিঃশব্দ হাহাকার।
কৃষকদের শেষ কথাই যেন হৃদয়ে ধ্বনিত হয়— ‘নবান্ন শুধু উৎসব নয়, এটি আমাদের জীবনের গল্প। গল্পটা যেন হারিয়ে না যায়…।’

আহমেদ সাব্বির সোহেল, মানিকগঞ্জ