ডিবির বন্দিশালায় নাহিদ-আসিফদের ৩০ ঘণ্টার অনশন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনের সূচনা, আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন, শহীদ পরিবারের আর্তনাদ এবং আন্দোলন থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম-খুন ও দমন-পীড়নের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১ নং সমন্বয়ক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে-১ এ সাক্ষ্যদানকালে নাহিদ সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষী হয়ে এই জবানবন্দি দেন তিনি।
ট্র্যাইব্যুনালে মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। আমি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ১নং সমন্বয়ক ছিলাম। ২০১৮ সালে আমি প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। ওই সময় কোটা সংস্কারের জন্য একটি বড় ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল সেই আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রলীগ রাতের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে গিয়ে আক্রমণ করে।’
নাহিদ ইসলাম ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘এ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। যদিও আমরা চেয়েছিলাম কোটা সংস্কার, তবে সরকার কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করে। তবুও আমরা এটিকে আপাতত মীমাংসা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। এই ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের গ্রেপ্তার শুরু করে এবং ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে। পরবর্তী সময়ে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করে। এরপর সরকারের আচরণে আমরা বুঝতে পারি, সরকার আন্দোলন দমনের জন্য কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোটা পদ্ধতি বাতিল চায়নি। কিছুদিন পর শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, আমি রাগের বশবর্তী হয়ে কোটা বাতিলের কথা বলেছি।’
ট্রাইব্যুনারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছিলাম, কোটা প্রথা আবার ফিরে আসতে পারে। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। আমি সে নির্বাচনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। নির্বাচনে অনিয়মের মাধ্যমে আমাদের হারিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ পদে ছাত্রলীগকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গণরুম-গেস্টরুম নির্যাতন কালচারসহ অন্যান্য অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হই। ’
‘২০২৩ সালে আমরা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করা এবং বিভিন্ন অনিয়ম দূর করাই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিলপূর্বক কোটা প্রথা পুনর্বহাল করেন। ওই দিনই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করি। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়। আমরা হাইকোর্টের ওই রায়টি স্থগিত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেই। এরপর ৩০ জুনের মধ্যে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম।’
আদালত ব্যবহার করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা
নাহিদ ইসলাম ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে বলেন, ‘৩০ জুনের মধ্যে সরকার কোনোরূপ সাড়া না দেওয়ায় আমরা ১ জুলাই (২০২৪ সাল) থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালপূর্বক কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে আন্দোলন শুরু করি। ২, ৩, ৪ জুলাই আমাদের আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি ছিল। ৪ জুলাই আপিল বিভাগে কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে আবেদনের শুনানি ও আদেশের কথা ছিল, কিন্তু সেদিন তা হয়নি। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বিধায় তাদের কিছু করার নেই। কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদালতে গিয়ে বলতে হবে। তখন আমরা জানতাম, বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার পরিকল্পিতভাবে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। সে কারণে আদালতে না গিয়ে আমরা রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখি।’
জুলাইয়ে আন্দোলন তীব্র করতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি
সাক্ষী নাহিদ ইসলাম ট্রাইব্যুনালে আরও বলেন, “আন্দোলন তীব্রতর করার লক্ষ্যে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে ৭ জুলাই সারা দেশে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করি। সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে এক মাসের স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করে। আমরা এতে হতাশ হই এবং নিশ্চিত হই, বিচার বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। অতঃপর আমাদের দাবি কিছুটা পরিবর্তন করে সরকারি চাকরিতে সব পর্যায়ে কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করি। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। আমরা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেট ছাত্রলীগ বন্ধ করে দিত, যাতে ছাত্ররা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দেওয়া হয়। সারা দেশেই এ ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবুও সব বাধা অতিক্রম করে আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখি। সারা দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করি। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি দেই।’
‘রাজাকারের বাচ্চা- নাতিপুতি’ গালিতে আন্দোলনের তীব্রতা
ট্রাইব্যুনালে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ এবং ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ অভিহিত করে কোটা প্রথার পক্ষে অবস্থান নেন। মূলত এই বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের একটি বৈধতা দেওয়া হয়। কারণ আমরা সবসময় দেখেছি, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায্য আন্দোলন করা হলে তাদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ন্যায্যতা নস্যাৎ করা হতো। ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ এবং ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যায়িত করায় সমগ্র দেশের ছাত্রছাত্রীরা অপমান বোধ করে। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল—ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। ১৫ জুলাই আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। একই দিনে ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচির ডাক দেয়। সেদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এই ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়, কারণ তারা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন।’
ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলা
আদালতে নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এই হামলায় নেতৃত্ব দেন। তারা বাইরে থেকেও সন্ত্রাসীদের এনে ক্যাম্পাসে জড়ো করেছিলেন। এই হামলায় বিপুল ছাত্রছাত্রী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রছাত্রীদের ওপর তারা নির্যাতন চালায় এবং চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়। এরপর ১৬ জুলাই আমরা এই হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। ওই দিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ছয়জন ওই দিন আন্দোলনে শহীদ হন।’
আন্দোলন প্রত্যাহারে ডিজিএফআইয়ের চাপ প্রয়োগ
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করি। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। সেদিন যাত্রাবাড়ীতে একজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ফেলে। গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল শুরু করলে পুলিশ মিছিলের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ আমাদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। সেদিন ডিজিএফআই আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার এবং সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দেয়। হলের বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে সংলাপে আমরা অস্বীকৃতি জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানাই। ১৭ জুলাই রাতে দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করি। আমাদের ভাইবোনদের হত্যা করা হয়েছে বিধায় আমরা সারা দেশের সব শিক্ষার্থী এবং সর্বস্তরের জনগণকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাই। আমাদের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই সারা দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা সেদিন রাজপথে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।”
গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন
‘আমরা আন্দোলনের নেতারা জীবনের হুমকির মুখে পড়ি এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যাই উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, সেদিন (১৮ জুলাই) সারা দেশে অনেক ছাত্র-জনতা আহত ও নিহত হয়। সেদিন রাতে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে ১৯ জুলাই পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অনেক ছাত্র-জনতা আহত ও নিহত হয়। ১৯ জুলাই আমরা বুঝতে পারি, সরকার ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। আমাদের আন্দোলনের এবং আহত ও নিহতদের কোনো খবর মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছিল না।’
নির্যাতন করে পূর্বাচলে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে যায়
জবানবন্দিতে মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে কোনো সংবাদ না পাওয়ায় আন্দোলনের অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশব্যাপী যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলেছে সে সম্পর্কে জানতে পারি। ১৯ তারিখ বিকেলে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে আমার কথা হয়। আমাদের পরামর্শ মতো সে ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন বিকেলে আমি নন্দীপাড়ায় আমার এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। পরবর্তী সময়ে সমন্বয়ক হাসনাত ও সারজিসের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন তারা ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে ছিল, যা আমি জানতাম না।
আমি অন্য সমন্বয়ক ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ২০ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই। সব মিডিয়াতে এই ঘোষণাটি পাঠালেও কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তা প্রচার করেনি। সেদিন দিনগত রাতে আমি জানতে পারি, সরকার কারফিউ জারি করেছে। কারফিউতে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল। নন্দীপাড়ার বন্ধুর বাসাতেই আমি রাতে অবস্থান করি। রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সে বাসায় প্রবেশ করে আমাকে হাতে হ্যান্ডকাফ, চোখে কালো কাপড় বেঁধে আটক করে একটি প্রাইভেট কারে করে তুলে নিয়ে যায়। প্রাইভেট কারে উঠিয়েই আমাকে মারধর করতে থাকে। এরপর আমাকে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার হাতে হ্যান্ডকাফ ও চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখত।
বন্দি অবস্থায় আন্দোলনে কারা জড়িত, কেন আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে না এসব জিজ্ঞাসা করা হতো উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম ট্রাইব্যুনালে বলেন, তারা আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতনের ফলে আমি কয়েকদফা জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারা আমাকে জানায়, আমাকে গুম করা হয়েছে, যদি আন্দোলন না থামাই তাহলে আমি আর কখনো বের হতে পারব না। আনুমানিক ২৪ ঘণ্টা পর শেষ রাতের দিকে আমাকে পূর্বাচল এলাকায় একটি ব্রিজের পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে চলে যায়। সেখান থেকে আমি আমার বনশ্রীর বাসায় যাই। আমার পরিবার আমাকে ঢাকার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।
হাসানাত-সারজিসকেও ডিজিএফআই তুলে নেয়
ট্রাইব্যুনালে নাহিদ বলেন, প্রেস ব্রিফিং করে আমাকে গুম ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করি। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সেদিনই আমি জানতে পারি যে, অনেক সমন্বয়ককেই গুম করা হয়েছে। আরও জানতে পারি যে, সমন্বয়ক হাসানাত, সারজিস ও হাসিবকে ডিজিএফআই জোর করে তুলে নিয়ে তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বসিয়েছে। সেই ছবি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।
২২ জুলাই ডিজিএফআই অফিসার লে. কর্নেল সারোয়ার হাসপাতালে আমার রুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ দেয় এবং হুমকি দিয়ে বলে, গুম হওয়া অন্য সমন্বয়কদের যদি জীবিত ফিরে পেতে চাই, তবে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে।
ডিজিএফআইয়ের কথামতো সংবাদ সম্মেলনে কথা না বলায় তারা আমাকে পুনরায় গুম করার হুমকি দেয়। ২৪ জুলাই সমন্বয়ক বাকের ও আসিফকে গুম অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন তারাও এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর হাসপাতালে আমাদের সম্পূর্ণ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। হাসপাতালে ইন্টারনেট, টেলিফোন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আমাদের সঙ্গে কাউকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। ডাক্তার ও নার্সদের আমাদের কোনো তথ্য প্রদানে সহযোগিতা না করতে ভয়-ভীতি দেখানো হয়।
৩০ ঘণ্টার বেশি ডিবি অফিসে অনশনে ছিলাম
ডিবি অফিসে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালে মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ২৬ জুলাই দুপুরের দিকে ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি হাসপাতালে এসে আসিফ, বাকের ও আমাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে ডিবিপ্রধান হারুন আমাদের আন্দোলন স্থগিত করতে বলে। অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন মামলা করা হবে বলে হুমকি দেন। আমরা প্রথমে রাজি হইনি। পরের দিন সমন্বয় হাসনাত ও সারজিসকে ডিবি অফিসে তুলে আনা হয়। এরপর সমন্বয়ক নুসরাতকেও ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমাকে ঔষধ সরবরাহ করা হয়নি। আমাদের অভিভাবকদেরও সেখানে আনা হয়। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং আন্দোলন বন্ধ না করলে বিভিন্ন রকম মামলা, নির্যাতন ও হয়রানির হুমকি দেওয়া হয়। আমাদের বলা হয়, আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে আরও নারী সমন্বয়ককে তুলে আনা হবে এবং নির্যাতন করা হবে। একপর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের লিখিত একটি বক্তব্য আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক পাঠ করিয়ে তা ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। তারা আমাদের জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমাদের তুলে আনা, আটক রাখা ও নির্যাতন করা হয়েছে।
একপর্যায়ে ডিবি প্রধান হারুন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরণ অনশন শুরু করি। আমরা প্রায় ৩০ ঘণ্টার অধিক সময় ডিবি অফিসে অনশনে ছিলাম। ডিবি অফিসে অবস্থানকালে জানতে পারি যে, আমাদের মুক্তির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে এবং আন্দোলন চলমান আছে। এরপর অসুস্থ অবস্থায় ১ আগস্ট আমাদের ডিবি অফিস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জাকের হোসেন