মাহমুদুর রহমানের সাক্ষ্যে শেখ হাসিনার ‘দানবীয়’ শাসনকাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে ভারতের পরিকল্পনা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা, শাপলা চত্বরে হত্যা, আদালতকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আয়নাঘর তৈরি, কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে শাহবাগে আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঘটনা উঠে এসেছে আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দিতে।
মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি শেখ হাসিনা সরকারের ‘দানবীয়’ শাসনকালের বর্ণনা দেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা ফাঁস প্রণব মুখার্জির
ট্র্যাইব্যুনালে বর্ষীয়ান সাংবাদিক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি একজন লেখক, ইতিহাস গবেষক এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া জানাই। আমি এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, পতন প্রত্যক্ষ করেছি। ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। এই ফ্যাসিবাদের উত্থান মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল। সেই প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত। আমি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’ থেকে উদ্ধৃতি ট্রাইব্যুনালকে জানাতে চাই, তিনি ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের সঙ্গে তার যে কথোপকথন হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তার সঙ্গে মঈন ইউ আহমেদের চুক্তি হয়েছিল, যদি শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়, তাহলে তৎকালীন সেনাপ্রধান আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং সেফ এক্সিট পাবেন। এই মিটিংটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছিল। আমাদের সবার মনে আছে, নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে। তার অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই নির্বাচনের ফলাফল দিল্লিতে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনে এই ফল হওয়ার পেছনে জেনারেল মঈন ও ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে তাপসের বিচার হয়নি
ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘ডিজিএফআইয়ে সেই সময় কর্মরত ছিল ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে ব্রিগেডিয়ার মামুন পরবর্তী সময়ে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জয়ের ব্যবস্থা করেছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আবশ্যক। কারণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে, তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই একটি বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে কোনো পুতুল সরকারকে মেনে নেবে না। সুতরাং পরিকল্পনা মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পিললকানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ধানমণ্ডির বাসিন্দা তাপস সরাসরি জড়িত।’
‘২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ তাপস এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগনেতারা মিলে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি তৈরি করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন হয়েছিল। তৎকালীন সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ তাদের পরিবারকে রক্ষা করার কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং দুই দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিল’, যোগ করেন মাহমুদুর রহমান।
ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর শেখ হাসিনার এক ধরনের ঘৃণা ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটি বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করব। বইটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার কৃষ্ণনান শ্রীনিবাসন। বইটির নাম ‘দ্য জামদানি রেভুলুশন (পলিটিকস, পারসোনালিটিজ অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি ইন বাংলাদেশ, ১৯৮৯-১৯৯২)’। এই বইতে তিনি ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেই সময় শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারতীয় হাইকমিশনার বিদায়ী সাক্ষাতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্য একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, ভারত যেন বলে তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা অন্য কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার এই জাতীয় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য শুনে হতবাক হয়ে যান। তিনি শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, ভারত এই জাতীয় কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি এ কথা বিশ্বাস করবে? শেখ হাসিনা আবারও হাইকমিশনারকে একই কথা বলেন’, যোগ করেন মাহমুদুর রহমান।
স্বৈরাচারী শাসনের জন্য সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ ধ্বংস
প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার সেনাবাহিনীর প্রতি বিদ্বেষ, বাকশাল পতনের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল বলে উল্লেখ করে সাক্ষী মাহমুদুর রহমান বলেন, সেই সময় সেনাবাহিনীর একাংশ, যারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; তাদের বিদ্রোহে এক দলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিল সর্বপ্রথম অথোরিটিয়ান রেজিম। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনা বিদ্বেষ ছিল। আমি আরও একটি বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। বইটির নাম ‘দ্য লিগেসি অব ব্লাড’ লেখক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। এই সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী সৃষ্টি করতে চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্পরূপে তিনি রক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই রক্ষী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনা বিদ্বেষের কারণে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মোরাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাক। বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করেন।’
আদালতকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ
ট্রাইব্যুনালে মাহমুদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হলে আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল—জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে সতর্ক করা। আমি লিখেছিলাম, বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকলে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র কিছুই থাকবে না। এই লেখার জন্য আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি ওই সময়ে আদালতের দুটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি করা হয়েছিল আদালতকে ব্যবহার করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলে চার বিচারপতিকে পুরস্কার
মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হলো—তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল। এই মামলা নিয়ে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট যত দূর মনে পড়ে আটজন এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমিকাস কিউরিদের মধ্যে শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধানে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যেও তিনজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। যে চারজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তারা হলেন—বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
এই চারজন বিচারপতিকেই তাদের সিনিয়রদের সুপারসিট করে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, সরকারের প্রতি আজ্ঞাবহ বিচারপতিদের পুরস্কৃত করার নীতি গ্রহণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করার পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এই লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, সব ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগণের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য একটা পাবলিক এনিমি কনসেপ্ট (গণশত্রু) তৈরি করে। হিটলারের জার্মানিতে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরবর্তী সময়ে ইহুদিদের এভাবেই গণশত্রু হিসেবে অভিহিত করে তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল।’
কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে শাহবাগ আন্দোলন
শাহবাগ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি দাবি করে ট্রাইব্যুনালকে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশেও একইভাবে ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণিকে নির্মূল করার পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন। এমনকি, ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন, প্রটোকলে না আটকালে তিনি নিজেও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজেমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল। শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে রেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাকে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফাঁসির দাবি করার বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের যেসমস্ত মিডিয়া ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানায়।’
ট্রাইব্যুনালকে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘তাদের ন্যায়বিচার না করে ফাঁসির দাবি এবং ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবির মধ্য দিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিবাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়। সেই সময় আমার দেশ পত্রিকা জনগণকে এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমরা একটি সংবাদ প্রকাশ করি, যার শিরোনাম ছিল—‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। এই সংবাদ প্রকাশ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। কিন্তু সরকার অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয় এবং এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়’, যোগ করেন মাহমুদুর রহমান।
‘শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়লে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয় উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সারা দেশ থেকে লাখ লাখ আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্র ঢাকায় এসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করে। আমার দেখামতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণজমায়েত সেদিন ঢাকায় হয়েছিল। ওই দিন তারা কতগুলো দাবিদাওয়া সংবলিত একটি আল্টিমেটাম দেয়। দাবিদাওয়াগুলো পূরণ না হওয়ায় ৫ মে তারা আবার ঢাকায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই দিনগত মধ্যরাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, সে সময়কার র্যাবের অপারেশন চিফ কর্নেল জিয়াউল আহসান ও বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। গণহত্যার পরের দিন এই তিনজন সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেন। সেই গণহত্যার পুরস্কারস্বরূপ বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং আজিজ আহমেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হয়। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক, আজ পর্যন্ত শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার বাংলাদেশে হয়নি।’
সাঈদীর মামলায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘শাপলা চত্বরে গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময়কার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করছিলেন তার একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকনোমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক তার বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত জিয়া উদ্দিন আহমেদ নামে এক বাংলাদেশির সঙ্গে নিয়মিত শলাপরামর্শ করতেন। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ ও ইমেইল আমার দেশ পত্রিকা এবং দ্য ইকনোমিস্ট পত্রিকার হাতে পৌঁছায়। সেই স্কাইপ কথোপকথনে দেখা যায়, পুরো বিচার প্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক, বেলজিয়ামে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহমেদ এবং ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন।’
ট্রাইব্যুনালে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, “এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। বিচারপতি নিজামুল হক সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুমকে আগে থেকে বলতেন, বিচার চলাকালে তিনি যেন মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে অবজেকশন জানান এবং বিচারপতি নিজামুল হক তাকে বসিয়ে দেবেন। ভাষাটা এরকম ছিল—‘আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু, সবাই মনে করবে যে আমাদের খাতির নাই’। নিজামুল হক সাহেব আরেকবার তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে পদোন্নতির জন্য তদবির করছিলেন। উত্তরে বিচারপতি এস কে সিনহা তাকে বলেছিলেন, পদোন্নতির আগে তাকে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও বিচারপতি এস কে সিনহা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। স্কাইপ কথোপকথন ও ইমেইলে যেসব নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিল, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল—এই মামলাগুলোর রায় পূর্বনির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা এবং দ্য ইকনোমিস্টে প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। আশ্চর্যের বিষয় শান্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। কিছু দিনের মধ্যেই তাকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেওয়া হয়। তারপর তাকে পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া হয় এবং বিচারপতির চাকরি থেকে অবসরের পরেও তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। অর্থ্যাৎ, ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল—সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে”, যোগ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক।
‘স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা পাঁচ দিনে পাঁচটি পর্ব প্রকাশ করতে পেরেছিল। এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে এই সংক্রান্ত সংবাদ আর ছাপানো সম্ভব হয়নি। আমার দেশ পত্রিকা এই ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করার ফলে আমার বিরুদ্ধে আইসিটি (তথ্য ও প্রযুক্তি আইন) আইনের ৫৭ ও ৫৮ ধারায় প্রথম মামলা করা হয় এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ এই ধরনের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশংসিত হয় এবং আইনসঙ্গত বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করা যায়। যে দুজন সাংবাদিক ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি উন্মোচন করেছিলেন, তাদেরকে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয় এবং সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, “২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সমর্থ হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সরকারি নিপীড়ন আরম্ভ হয়। কাদের মোল্লাকে তত দিনে তিনি ফাঁসি দিতে সক্ষম হন। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন—একতরফা নির্বাচন হলে তিনি সামাল দিতে পারবেন এবং এরপরে বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচনি তামাশা মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং তৃতীয়টি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কোনোরকম ভোট প্রদানের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। অর্থ্যাৎ, নির্ধারিত ভোটের দিনের আগেই প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই প্রকৃতপক্ষে ভোটদান সমাপ্ত করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের রাতের ভোট প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত এই দেশ থেকে তার বিদায়ের আগে সাংবাদিকদের বলে গিয়েছিলেন, পৃথিবীতে কোথাও ভোটের আগের রাতে ভোট প্রদান সমাপ্ত হয়ে যায় এটা বাংলাদেশেই প্রথম দেখলাম। ২০২৪ সালে আবারও অনেকটা ২০১৪ সালের মতো একতরফা ভোটবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেই নির্বাচনটি ‘আমি ও ডামির ভোট’ হিসেবে কুখ্যাত হয়েছিল।”
ড. মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘কীভাবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তিনি ও তার সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, গুম করেছে, হেফাজতে নির্যাতন করেছে এবং আয়নাঘর বানিয়েছে।’
নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনা মাহমুদুর রহমানের
নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালে বলেন, ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে র্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে প্রথমে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর আইন বহির্ভূতভাবে আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়াই ডিবি থেকে আমাকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় ও হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তারপর অন্ধকার সেলে নিয়ে আমাকে গারদের শিকের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। টিএফআই সেলে আমাকে শারিরীক নির্যাতন না করা হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমি পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের এক একজনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো। সেখানে বেশিরভাগই আলেম শ্রেণির মানুষ ছিলেন। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয়তো মানসিক টর্চার করবার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়েছিল। আমি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়েছিলাম। যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত এবং নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাঙানো ছিল। এখানে আমাকে এক দিন রাখা হয়েছিল।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, “আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে রাত ১টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাঁচ-ছয়জন আততায়ী আমার সেলে প্রবেশ করে আমাকে বিবস্ত্র করে। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার ওপরে টর্চার শুরু করলে খুব দ্রুত আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখতে পাই আমাকে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের রুমে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সারা শরীর পানিতে ভিজা ছিল। ধারণা করতে পারি, আমার জ্ঞান ফিরানোর জন্য আমার শরীরে পানি ঢালা হয়েছে। টিএফআই সেল ও ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনা আমার লেখা ‘জেল থেকে জেলে’ নামের বইতে বিস্তারিত লিখেছি। বইটি ২০১২ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৩ সালে আমি দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হলে আমাকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় আমি ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলাম। দ্বিতীয় দফার রিমান্ডের সময় আমার সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এর আগে আমি দেলোয়ার হোসেনকে চিনতাম না। দুই দিন আমার সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন ডিবির একই গারদে ছিল। সেই সময় আমি দেলোয়ারের ওপর ভয়াবহ টর্চার দেখতে পেয়েছি। তাকে সন্ধ্যার পরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সেল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। মধ্য রাতে দুই-তিনজন পুলিশ তাকে বহন করে আবার গারদে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। টেনে নিয়ে আসার পর সে শুধু যন্ত্রণায় কাতরাতো, কথা বলতে পারত না, উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি থাকত না। দুই দিন পর ডিবি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, আমার সঙ্গে দেলোয়ারকে রাখলে ভবিষ্যতে আমি তার ওপর নির্যাতনের সব কাহিনী প্রকাশ করব। সেজন্য তাকে আমার গারদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ও দেলোয়ার শেখ হাসিনার ১৫ বছরব্যাপী জুলুমের প্রত্যক্ষ উদাহরণ।”
শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদের নাটক
‘ভিন্নমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপপ্রচার করে’ উল্লেখ করে ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, “জঙ্গি দমনের নামে তারা কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরি করেছে। এই সমস্ত নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় জনগণের ওপর জুলুম চালানো হয়েছে। এদেরকে জঙ্গি সাজিয়ে ‘ফেক অ্যানকাউন্টারে’ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভিকটিম বানানো হয়েছে যাতে করে তাদের জন্য বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এরকম একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির জঙ্গি নাটক। সেখানে ডিবি থেকে কয়েকজন গুমের ভিকটিমকে ধরে এনে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়। এই পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই জঙ্গি নাটকের মূল ভূমিকা পালন করেছিল পুলিশের মনিরুল ইসলাম ও আসাদুজ্জামান। সারা দেশে কিছু দিন পরপর এই ধরনের জঙ্গি নাটক সাজানো হয়েছে, যাতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা নিজেকে ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে শেখ হাসিনা জঙ্গি দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে।”
ড. মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনী, বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দীক মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি জুগিয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ও মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ এবং পুলিশের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুন অর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছে’, যোগ করেন সাক্ষী মাহমুদুর রহমান।
নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস
ট্রাউব্যুনালে মাহমুদুর রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনার এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জি এম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৪ দলীয় নেতাদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার এবং তাদের সঙ্গীও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, শমশের মুবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিজবাউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী ও ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে তিন সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ ও জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না। ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস ও হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছে।’
ট্রাইব্যুনালে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, “বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবসময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানিন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ ও ২০২৪ এর ভুয়া নির্বাচনের পরেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকা ও ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণেরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে। এ প্রসঙ্গে আমি বুয়েটের শহীদ আবরার ফাহাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। কেবল ভারতের আধিপত্ববাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার জন্যে সারা রাত ধরে তার ওপর নির্মম অত্যাচার করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছিল। আমি বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের চিত্র আমার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি ইংরেজি ভাষায়। প্রাসঙ্গিক বইয়ের মধ্যে ‘হাসিনার ফ্যাসিবাদ নির্বাসন থেকে দেখা’, ‘গুমের জননী’, ‘দ্য পলিটিকেল হিস্ট্রি অব মুসলিম বেঙ্গল’ ও ‘দ্য রাইজ অব ইন্ডিয়ান হেজিমন ইন সাউথ এশিয়া’ অন্যতম।”
জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এক জুলুমকারী
আদালতে ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাঈফুল আমিন, তাবরেজ শামস ও হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এক জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবসময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা
ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার মহান জুলাই বিপ্লবের সময় যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণহত্যা চালানের জন্যে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতি রাতে তার বাড়িতে কোর কমিটির সভা করতেন। সেখানে পুলিশ এবং অনান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করতেন। সেই সভায় তারা বিক্ষোভকারী এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপরে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনা করতেন। সেসব সভায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাতে জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের ওপর যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে মিডিয়াতে ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের হত্যা করে মরদেহ গুম করার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ওপর সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় পড়ে।’
ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই বিপ্লবে প্রায় এক হাজার ৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে। এই রিপোর্টটিতে প্রধানত জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে যে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে অবর্ণনীয় জলুম জালিয়েছে, সে সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়মিত আলোচনা এবং সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতি বছর যে হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে, সেগুলোতেও শেখ হাসিনার শাসন আমলে বংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে তিনটি ভুয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে সম্পর্কেও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টেও উক্ত তিনটি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।’
অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান
মাহমুদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, “আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মধ্যে আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল। সেখানে শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর দুর্নীতি এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, কোনো ফ্যাসিস্ট রেজিম কিংবা অটোক্রেটিক গণতান্ত্রিক উপায়ে অপসারিত করা সম্ভব হয় নাই। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভ্যুলুশনের সময় মিসর এবং তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি ও হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর। জার্মানিতে সেই সময় জনগণ, বিশেষ করে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে আওয়াজ উঠেছিল ‘নেভার এগেইন’, অর্থাৎ আর যেন কখনো হিটলারের মতো নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট শাসকের আগমন না ঘটে। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার ১৫ বছরের চরম দুর্নীতিপরায়ন এবং মানবতাবিরোধী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা হলো আর যেন কখনও আমাদের দেশে এমন ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রত্যাবর্তন না ঘটে।’
১৪০০ শহীদের পিতা-মাতা বেঁচে আছেন বিচারের আশায়
ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে জুলাই শহীদ ফাইয়াজের বাবা আমাকে ফোন করেছিলেন। একদিন পরে তার ছেলের ১৮ বছর হওয়ার কথা ছিল। ফাইয়াজ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রিকশা করে বাড়িতে ফিরছিল। সেই রিকশার মধ্যেই ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ সেই কিশোরকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শহীদ ফাইয়াজের পিতা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তার শহীদ ছেলের জন্মদিনে আমি যেন আমার দেশ পত্রিকায় একটা সংবাদ ছাপাই। আমি সেই পিতার অনুরোধ রক্ষা করেছি। শহীদ ফাইয়াজের পিতার মতো এমন অন্তত এক হাজার ৪০০ শহীদের পিতা ও মাতা সন্তানের শোক নিয়ে বেঁচে আছেন। এই শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এর সঙ্গে আরও যে অন্তত ২০ হাজার আহত জুলাই যোদ্ধা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তারাও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কমান্ড রেসপনসিবিলিটিতে যারা ছিলেন তাদের বিচার দেখতে চান। এই আসামিদের মধ্যে যারা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা উক্ত হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি, তারা সবাই কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতাভুক্ত।’
মাহমুদুর রহমান জবানবন্দিতে ট্রাইবুনালকে বলেন, “আমি বিগত ১৬ বছর ধরে এই ফ্যাসিবাদের উত্থান, বিকাশ ও পতন প্রত্যক্ষ করেছি। এই বিষয়ে অনবরত লেখালেখি করেছি এবং বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেছি। জুলাই গণহত্যার পর যখন এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে, আমি মনে করেছি—রাষ্ট্রের একজন বর্ষিয়ান নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য ট্রাইব্যুনালকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। সেই সহযোগিতার অংশ হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করছি। আমি চাই অপরাধীরা যেন সাজা পায়, শহীদ পরিবার, আহত জুলাই যোদ্ধা এবং তাদের পরিবার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তাদের শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। এ ছাড়া ফ্যাসিস্ট শাসনের বিষয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভবিষ্যতের সরকাগুলোহ সতর্ক হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেভাবে বলা হয়েছিল ‘নেভার এগেইন’, বাংলাদেশেও এই বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক যেন গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি আর না হয়।”

জাকের হোসেন