শেখ হাসিনা উপস্থিত হয়ে সহযোগিতা করলে ভালো হতো : আইনজীবী
রাষ্ট্র নিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেছেন, ‘আমি সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কাজ করেছি। শেখ হাসিনা উপস্থিত হয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে আরও ভালো হতো। প্রসিকিউশন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে, আশা করি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারব। আমার প্রত্যাশা আমার আসামিরা খালাস পাবেন।’
আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে এসব কথা বলেন আইনজীবী আমির হোসেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তিনজনের রায় আজ সোমবার ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এদিন নাশকতাসহ যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবিলায় রাজধানীজুড়ে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আজ বেলা ১১টায় হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। এ মামলার রায় ঘোষণা বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করার কথা রয়েছে।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি এবং প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে মারাত্মক আহত করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আলোচিত এই মামলার রায়ের দিন ধার্য করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এই মামলায় বিচারের জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়। বিচার চলাকালে মোট ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও ও অন্যান্য প্রমাণ আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তবে মামলার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে অন্য আসামিদের সব অপরাধের বর্ণনা দেন।
এ মামলায় সাক্ষীরা হলেন জুলাই অভ্যুত্থানে মারাত্মক আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ, পুলিশের গুলিতে আহত আব্দুল্লাহ আল ইমরান, পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো দিনমজুর পারভীন, রংপুরের এনটিভির সাংবাদিক এ কে এম মঈনুল হক, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মুর্মু, শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম, শহীদ ইমাম হাসান তাইমের বড় ভাই রবিউল হাসান, ইবনে সিনা হাসপাতালের ডা. হাসানুল বান্না, শহীদ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল, ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান, রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকারী চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম, রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা, জুলাই আন্দোলনে শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা মো. ইদ্রিস, সাংবাদিক মোহিদ হোসেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, জুলাই আন্দোলনের ১ নম্বর সমন্বয়ক ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও জবানবন্দি দিয়েছেন প্রসিকিউর তানভীর হাসান জোহা, সবজি বিক্রেতা আবদুস সামাদ, মিজান মিয়া, আহত শিক্ষার্থী নাঈম শিকদার, শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি, প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন, কুষ্টিয়ার সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের মা হোসনে আরা বেগম, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত তিনজনের প্যানেল এই রায় ঘোষণা করবেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ, সুলতান মাহমুদ, মো. সহিদুল ইসলাম সরদার, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, এস এম মইনুল করিম, তারেক আব্দুল্লাহ, মো. মামুনুর রশীদ, আবদুস সাত্তার, এস. এম তাসমিরুল ইসলাম।
শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন।
গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। ওই দিনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে লকডাউন কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। নিয়ে উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়। গত কয়েকদিনে সারা দেশে অর্ধশত গাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি প্রতিরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রায়কে কেন্দ্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শেখ হাসিনার মামলায় রায়ের জন্য ১৭ নভেম্বর ধার্য করা হয়েছে। যারা সারা দেশে নাশকতা করছে তাদের বিষয়টি প্রশাসন দেখবে।
চলতি বছরের ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠা অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো হলো:
প্রথম অভিযোগ—রাজাকারের বাচ্চা বলে হত্যার উসকানি : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা-আক্রমণ করে। তাদের গুলি ও হামলায় প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
দ্বিতীয় অভিযোগ—প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের কাছেও এই নির্দেশ পৌঁছে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ দায় বা সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের ওপর বর্তায়।
তৃতীয় অভিযোগ—আবু সাঈদ হত্যা : ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনার দায় চাপিয়ে নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলাও করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন, আলামত নষ্ট এবং পাল্টা মিথ্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে এই তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
চতুর্থ অভিযোগ—চানখাঁরপুলে আনাসসহ ছয় হত্যা : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চানখাঁরপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাসসহ (শহীদ আনাস) ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ—আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাদের মরদেহ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
এ মামলার অভিযোগ গঠনের দিন ১০ জুলাই রাজসাক্ষী হন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তখন ট্রাইব্যুনাল পক্ষ থেকে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ৩ আগস্ট। মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ করা হয়। এ সময় মামলার কার্যক্রম ও শুনানি বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। শুনানিকালে সাক্ষীদের বর্ণনায় উঠে আসে রাষ্ট্রীয় মদদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৃশংসতা, সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্তনাদ, চোখ হারানো ও পঙ্গু জুলাইযোদ্ধাদের আহাজারি। দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে ১৬ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক চলে। এ সময় সমাপনী বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, আসামিদের আইনজীবী আমির হোসেন ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
তাজুল ইসলাম সমাপনী বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে নিউক্লিয়াস বা প্রাণভোমরা হিসেবে শেখ হাসিনাকে চিহ্নিত করে বলেন, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে এই ‘প্রাণভোমরা’কে অবশ্যই বিচারিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য যদি একবার করেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে শেখ হাসিনার এক হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যায় না। যদি শেখ হাসিনাকে এই চরম দণ্ডাদেশটা দেওয়া হয়, তাহলেই ভুক্তভোগীদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে। এত মানুষ হত্যার পরও তার কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো মানুষ হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাগুলো তিনি বারবার বলছেন। তার প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
অপরদিকে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন, আসামিদের খালাস চেয়ে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সরকার চালাতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হয়, শেখ হাসিনাও কিছু ভুল করেছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়। আমার অভিমত, সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আমি আমার মক্কেল নির্দোষ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের খালাস প্রত্যাশা করি।
সবশেষে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি এবং শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের যদি শাস্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের মানুষ। এই আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের আরও অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি। কেননা গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি অবিচার করা হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। দুই পক্ষই যেকোনো মূল্যে ন্যায়বিচার পাবে।’
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর বিধান অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আরও বেশ কয়েকজনের বিচার চলছিল।
তবে ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের আগের বিচারককে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়নকে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বিবেচনা করে একই ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে মামলা
২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ও পলাতক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৫৬টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন কার্যালয়ে জমা পড়ে। এর মধ্যে ৫৪টি অভিযোগেই প্রধান আসামি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন।
প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য শুরুতে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেন। প্রথমে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলে পরে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন একাধিক মামলা করে। এর মধ্যে ১ জুন প্রথম মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক