যেসব অভিযোগে শেখ হাসিনা-কামালের সর্বোচ্চ দণ্ড
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগে বিচার শুরু হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) রায় ঘোষণার সময় এসব অভিযোগকে দুটি বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে মোট ৬টি অপরাধের জন্য দণ্ড ঘোষণা করেন।
যে অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড
প্রথম অভিযোগের অধীন তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য। এই তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
অভিযোগ উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, অনেকগুলো ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন।
শেখ হাসিনা একই ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, চারখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তার আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলে বর্ণনায় এসেছে। একইভাবে অন্য একটি ঘটনায় তিনি একই অপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ কারণে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই তিনটি ঘটনায় তাকে (শেখ হাসিনা) একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা।
এ সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত অনেকে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আপনাদের অনুরোধ করছি আদালতের ডেকোরাম বজায় রাখার জন্য। আপনাদের উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশা, প্রকাশভঙ্গি ট্রাইব্যুনাল কক্ষের বাইরে গিয়ে করলে সেটি আরও শোভনীয় দেখা যাবে।
যে অভিযোগে আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনার জন্য। এ ঘটনার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে দায়ী সহযোগিতার জন্য এবং নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য।
উভয় (চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া) ক্ষেত্রে ছয়জন করে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের অধীন আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা। এসব ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন এবং তিনি ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তার সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার অবদান বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের।
রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম সাংবাদিকদের বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তার দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছে- এসব দিক বিবেচনায়।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের হুবহু কপি নিম্নরূপ
শেখ হাসিনার মামলার রায়ে মোট ২টি অভিযোগ।
৬টি কাউন্ট।
অভিযোগ ১: ৩টি কাউন্ট
কাউন্ট ১: ১৪ই জুলাই ২০২৪ তারিখ গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।
কাউন্ট ২: ১৪ই জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সাথে শেখ হাসিনার কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাদের ফাঁসি দিব মর্মে উসকানি ও আদেশ দেন। এবং অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাঁর অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।
কাউন্ট ৩: এরই ফলশ্রুতিতে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক গুলি করে হত্যা।
শাস্তি: শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল এর আমৃত্যু কারাদণ্ড।
অভিযোগ ২: ৩টি কাউন্ট
কাউন্ট ১: ১৮ই জুলাই, ২৪ তারিখ শেখ হাসিনা সাথে তাপসের এবং পরবর্তীতে হাসানুল হক ইনুর সাথে কথোপকথনে দেখা যায়, আসামি শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হেলিকপ্টার এবং লেথাল উইপন ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাঁর অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।
কাউন্ট ২: যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট, ২০২৪ চানখাঁরপুলে ৬ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
কাউন্ট ৩: যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখ পুলিশ কর্তৃক আশুলিয়ায় ৬ জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
শাস্তি: শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড।

জাকের হোসেন