সংস্কারের দাবিতে সড়কে ধান রোপণ, ধান কেটে পিঠা উৎসব
নওগাঁর বদলগাছীর গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সড়ক ডাকবাংলো মোড় দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ চলাচল করেন। বর্ষায় কাদা-পানির ঝামেলা আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলোর দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে চার মাস আগে স্থানীয়রা ডাকবাংলো তিনমাথার মোড়ে সড়কের ওপরই ধানের চারা রোপণ করেন। যত্নে-আদরে সেই সড়ক একসময় সবুজ ধানের ক্ষেতে রূপ নেয়। দীর্ঘদিন সংস্কারহীন এই পথ এখন স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘ধানের রাস্তা’ নামে। আর যখন সেই রাস্তার ধান কাটা হলো, স্থানীয়দের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আয়োজন করা হয় পিঠা উৎসব। হাসি-আনন্দে ভরা এই আয়োজনের আড়ালে লুকিয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ ও অবহেলার গল্প।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে ভাঙাচোরা সড়কটি মেরামতের দাবি জানাতে জানাতে মানুষ ক্লান্ত। বর্ষায় গর্তে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, শুকনো মৌসুমে ধুলোয় চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে আসে। আর এই অবহেলার প্রতিবাদে ধানের চারা রোপণ করেন স্থানীয়রা। কেউ প্রথমে বিষয়টি মজার ছলে দেখলেও, পরে সেটিই হয়ে ওঠে মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক।
স্থানীয় কৃষক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, যে রাস্তায় গাড়ি চলাচলে সমস্যা, সেখানে ধান জন্মালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবাক হওয়া উচিত যারা দেখেও দেখেন না, তাদের আচরণে। ধান গাছে যখন শীষ আসল, স্থানীয়দের অভিমান তখন আর চেপে রাখা গেল না। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এই ধান শুধু কাটবেনই না, বরং এই ধানের চাল দিয়ে আয়োজন করবেন এমন এক উৎসব, যার বার্তা পৌঁছে যাবে প্রশাসনের টেবিল পর্যন্ত।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) বিকালে বদলগাছীর সেই সড়কে দেখা গেল এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য- রাস্তার এক পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কয়েকজন পুরুষ ধান কাটছেন, আর ঠিক ওপারে কৌতূহলী শিশুরা জড়ো হয়েছে দেখার জন্য। কারও হাতে কাঁচি, কারও হাতে হাসি; সড়কটি মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল জনমতের এক বৃহৎ মঞ্চে, যেখানে প্রতিবাদ আর উৎসব একসঙ্গে মিলেমিশে গেছে।
ধান কাটা শেষ হতেই শুরু হয় পিঠা তৈরির পালা। হাঁড়িতে ভাপ উঠতে থাকে, চুলায় শুঁটকি-জ্বালানির গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন চালের খই ভাঙার টুংটাং শব্দে মুখর হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। স্থানীয় নারীরা একে একে তৈরি করেন ভাপা, পুলি, চিতই, দুধপুলি- সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক অনন্য ‘প্রতিবাদী পিঠা উৎসব’, যেখানে আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে দাবি আদায়ের দৃঢ় মনোভাব।
স্থানীয় গৃহিণী সাহেরা বলেন, আমরা কষ্টের ভাত খাই, কষ্টের পিঠা বানাই। এই পিঠা যেন আমাদের না বলা কথার মিষ্টি প্রতিবাদ।
স্থানীয় বাসিন্দা নয়ন হোসেন হাসির আড়ালে জমে থাকা ক্ষোভ স্পষ্ট করে বলেন, রাস্তাটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে হয়তো পরের বছর আমরা আরও বড় মাঠ পাবো ধান রোপণের জন্য।
উৎসবের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই আলোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই লিখেছেন, ‘যেখানে রাস্তা ঠিক করা যায় না, সেখানে জনগণ সৃজনশীলতা দিয়ে সমস্যাকেই উৎসবে রূপ দেয়।’

মিঠু হাসান, নওগাঁ (বদলগাছী-মহাদেবপুর)