নায়কের মুখোমুখি
প্রসেনজিতের কাছে বাংলাদেশ মানেই নস্টালজিয়া
‘বাংলাদেশ মানেই আমার কাছে নস্টালজিয়া। কলকাতা থেকে যখন উড়ানে বাংলাদেশ যাই, তখন মনেই হয় না অন্য কোনো দেশে বেড়াতে এসেছি। মনে হয়, এই তো যেন একই বাংলায় ঘুরতে এসেছি। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, ভাষা সবই এক। সকালে উঠে মনে হয়, আরে, কলকাতার বুকে বসে নেই তো! এ এক আশ্চর্য ফিলিং। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেড টি খাওয়ার সময় বাঙালিয়ানা অনুভবটা আরো বেশ করে উপলব্ধি করি বাংলাদেশে এসে। বাংলাদেশের হোটেলে যখন কেউ চা নিয়ে আসে, মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। একই রকম চায়ের স্বাদ, যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে গেলে পাই না। বাংলাদেশ আমার কাছে নিজের দেশের মতোই।’
এভাবেই ওপার বাংলার নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিজের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন এনটিভি অনলাইনের কাছে। তিনি বললেন, “এই তো কিছুদিন আগেই পরিচালক গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’ ছবির শুটিংয়ের জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। এই ছবির জন্য এক বছরে তিনবার বাংলাদেশ গেলাম। তখন অনেক ঘুরেছি। বাংলাদেশের বগুড়া, গোপালগঞ্জের কিছু জায়গায় আমাদের মেইন শুটিং স্পট থাকলেও রাজশাহী এবং রংপুরেই টুকরো টুকরো শুটিংয়ের জন্য ঘুরেছি। ভীষণ ভালো জায়গা। বলতে পারেন মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো স্পট। তবে টাইট শিডিউলের জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখাটা মিস করলাম। ফিরে আসতে হলো। আর এই ফিরে আসা নিয়ে আমার ছেলে তো আমার ওপর মহা খাপ্পা। এমনিতেই আমার ছেলে তৃষাণজিৎ ক্রিকেটপাগল। তার ওপর বাংলাদেশের খেলা কেন তাকে দেখাইনি, তাই নিয়ে তো ছেলে আমার সঙ্গে দুদিন কথাই বলেনি।”
কথায় কথায় প্রসেনজিৎকে এবার প্রশ্ন করা হলো রাজনীতি নিয়ে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি হেসে উঠলেন; বললেন, ‘আপনারা মিডিয়ার লোকজন, কি না ভাবেন, আর কি না লেখেন বলুন তো? এই তো কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে শুটিং সেরে ফিরতেই কলকাতায় এসে শুনলাম, আমি নাকি পশ্চিম বাংলার হয়ে প্রশাসনিক কাজে ওখানে অ্যাম্বাসাডর হয়ে গিয়েছিলাম। (এবারে জোরে হেসে উঠে) তাহলে বুঝতেই পারছেন তো! আপনারা কী না কী ভেবে বসেন। আসলে কী জানেন তো! আমার দ্বারা রাজনীতিটা হবে না। আমি শিল্পী, আমি অভিনেতা। আর আমি সেটা হয়েই থাকতে চাই। আমি আমার সীমাবদ্ধতা জানি। আমি শিল্পী, অভিনয় পারি। রাজনীতির ধারেকাছে দিয়ে যাই না। অবশ্য ভবিষ্যতের কথা জানি না। তবে বর্তমানে কোনো রাজনীতির মধ্যে নেই আমি। বাংলা ছবির জন্য লড়াইটা আগেও করেছি, এখনও করব।’
‘আমি যখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি, তার কয়েক বছর আগেই উত্তম জেঠু (উত্তম কুমার) মারা গেছেন। বাংলা ছবিতে তখন খরা। সে সময় স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরীদের কমার্শিয়াল ছবির হাত ধরে বাংলা ছবি লাভের মুখ দেখছিল। তখন মাত্র ১৫ লাখ টাকায় একটি বাংলা ছবি তৈরি হতো। সেখানে দাঁড়িয়ে এখনকার একেকটি বাংলা ছবির বাজেট ৬ থেকে ১২ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে বিদেশে শুটিং...। আর কী চাই! আমরা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির যুগ থেকে ঢুকে গেলাম রঙিন ছবির যুগে। স্টিরিওফোনিক সাউন্ড থেকে এলাম ডবলি সাউন্ডে। বিদেশে আজ বাংলা ছবির নিজস্ব দর্শক তৈরি হয়েছে। তা সেটা এপার বাংলা বলুন বা ওপার বাংলা বলুন, যা দুই দশক আগেও ভাবা যেত না। হিউজ পরিবর্তন দেখলাম আমি আমার ৫০ বছরের অভিনয় জীবনে। সত্যি আমি ভাগ্যবান যে, এই চেঞ্জের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারলাম আমি। আজকের দিনে বাংলা ছবির জগৎকে একটি স্বতন্ত্র ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে মানা হয়, যা আগে হতো না। এটাও কম সৌভাগ্যের নয়।’
‘বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে নেক্সট প্রজন্ম আজ বাংলা ছবি দেখতে ও তাতে অভিনয় করতে ভালোবাসে, পছন্দ করে। এই যে আমরা ওদের ভালো লাগাতে পেরেছি, সেটাই তো অনেক।’ প্রসেনজিৎ আরো বলেন, “আমি আমার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে পুরোই কমার্শিয়াল ছবি করেছি। ফাইট-অ্যাকশনে ভরপুর। তার পর আমি আস্তে আস্তে মেইনস্ট্রিম ছবির সঙ্গে প্যারালাল ছবি করাও শুরু করি, যেমন—অটোগ্রাফ’, ‘চোখের বালি’। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলা ছবির দর্শক বদলাচ্ছে, তাঁদের স্বাদ বদলাচ্ছে। তাঁরা ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘মনের মানুষ’ দেখতে চাইছেন। তখন থেকেই ছবির স্প্যান বাড়ল। বাংলা ছবির আলাদা ঘরানা তৈরি হলো।”
প্রসেনজিৎ তাঁর নিজের প্রযোজক হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে বলেন, “ইচ্ছা ছিল ইয়ং ছেলেমেয়েদের একটা অভিনয় করার প্ল্যাটফর্ম দেব। সেই ভাবনা থেকে আমি ও আমার স্ত্রী (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়) মিলে ‘আইডিয়াজ’-এর কাজ শুরু করি।”
খুব সাবলীলভাবে উঠতি প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন প্রসেনজিৎ। পরের প্রজন্মের সঙ্গে সমানভাবে কাজ করে যাওয়ার কোনো গোপন মন্ত্র আছে কি? উত্তরে প্রসেনজিৎ বলেন, ‘খুব সহজ মন্ত্র। কাজের প্রতি আমার নিরলস ভালোবাসা। সেটাই আমার একমাত্র এনার্জি। সে জন্য আজো আমি বাংলা ছবির হেডলাইন তৈরি করি।’
স্বপ্নের চরিত্র বলতে কি অধরা রয়েছে এখনো আপনার? প্রসেনজিৎ বলেন, “দুটি চরিত্রের কথা বলব। এক, সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের চরিত্র এবং দুই, ‘দ্য বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবিতে রাসেল ক্রো যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন—এ দুটি চরিত্রে আমি অভিনয় করতে চাই। এই দুটিই আমার স্বপ্নের চরিত্র।” কথায় কথায় শেষ পর্যায়ে নিজের পরিবার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রসেনজিৎ বলেন, “আমার ছেলে তৃষাণজিতের বয়স আট বছর হলো। ও বড় হয়ে কী হবে, তা নিয়ে আমি এবং অর্পিতা মোটেই ভাবি না। আগে ও পড়াশোনা করুক, বড় হোক, তার পর ও নিজে ভাববে কী হবে। তবে (মুচকি হেসে) আমি বলতে পারি, ও এখন থেকেই ক্রিকেটার সৌরভের খুব ভক্ত। তাই ও যা-ই করুক না কেন, ক্রিকেট খেলবেই। তার পর দেখা যাক কী হয়...।”
সবশেষে বাংলাদেশের অসংখ্য প্রসেনজিৎ-গুণমুগ্ধদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘সবাই ভীষণ ভীষণ ভালো থাকুন, আর বেশি বেশি করে বাংলা ছবি দেখুন। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’