‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের ৩২তম প্রদর্শনী আজ
শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাস থেকে এর মঞ্চ নাট্যরুপ দিয়েছেন সৌম্য সরকার ও সামিনা লুৎফা নিত্রা। নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। নাটকটি বটতলার ৯ম প্রযোজনা।
নাটকটি আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চায়িত হবে। এটি হবে নাটকটির ৩২তম প্রদর্শনী।
নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমরান খান মুন্না, কাজী রোকসানা রুমা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, তৌফিক হাসান ভুঁইয়া, পঙ্কজ মজুমদার, ইভান রিয়াজ, ম. সাঈদ, মনজুরুল ইসলাম রনি, গোলাম মাহবুব মাসুম ও নাফিউল ইসলাম প্রমুখ।
নাটকটির গল্পে দেখা যাবে, “একটি নাটকের দল এত দুঃখ, কান্না, সাহসের গল্প থেকে বলতে শুরু করে এক কর্নেলের গল্প।এক বা একাধিক স্বপ্নবাজ, পাগল, মৃত্যুর নেশায় পাওয়া মানুষদের গল্প। একটি সময় ও দুঃসময়ের গল্প। একটি স্থানের ও কালের গল্প হয়েও যেটি কেবল একটি স্থানের ও কালের গল্পমাত্র নয়। লোকে বলবে ‘ঐতিহাসিক গল্প’ কিন্তু যারা জানে ইতিহাস মানুষের হাতে রচিত হয় অনেক সময় কিছু মানুষের প্রয়োজনে, যে মানুষগুলো ক্ষমতাধর তাদের কাছে ইতিহাস একটি জটিল বিষয় আর যেহেতু সময়ের বদলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা বদল হয়! নাটকের দলটি তাই তাদের গল্প তাদের মতো করে বেছে নেয় আর তাদের মতো করে বুঝবার ও বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু, এই দলটি যেহেতু সমকালের অংশ তাই সেও সংকটমুক্ত নয় তাদের সংকট তারা এখনো নায়ক খুঁজে পায়নি, নায়ক বুঝেও পায়নি তারা আবার এমন এক দেশের গল্প বলে যে দেশটিও নায়ক খুঁজে পায়নি, বুঝে পায়নি। কিন্তু নায়ক কেন লাগবে? বোকার প্রশ্ন! নায়ক ছাড়া চলবে কেন?
গ্যালিলিও নাটকের চরম সংকটকালে শিষ্য আন্দ্রেয়া বলে বসে: ‘সেই দেশই দুর্ভাগা যে দেশ কোনো নায়কের জন্ম দেয় না’। গ্যালিলিও মৃত্যুর ভয়ে এইমাত্র তার সত্য বিক্রি করে এসেছে চার্চের কাছে আন্দ্রেয়া তাই গভীর মর্মবেদনায় উচ্চারণ করে এই বাক্য: গ্যালিলিও যে তার নায়ক ছিল! গুরু গ্যালিলিও জবাব দেয় মর্মপীড়ায়: ‘না আন্দ্রেয়া, সেই দেশই দুর্ভাগা যে দেশের একজন নায়কের প্রয়োজন হয়।’ কিন্তু এ তো আর রবীন্দ্রনাথের আইডিয়াল রাজ্য নয় যেখানে আমরা সবাই রাজা! নাটকের দলটি সেই অর্থে দুর্ভাগা, বাংলাদেশ সেই অর্থে দুর্ভাগা!
কর্নেল তাহেরের জীবনের প্রস্তুতি, প্রেম, সংগ্রাম ও মৃত্যুর গল্প বলতে গিয়ে নাটকের দলটিকে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বিস্তৃত ঘটনারাশির কথা বলতে হয় তখনই সংকট! মিডিয়ার দখলে থাকা সংস্কৃতির ভাগীদার হয়ে, পরস্পরবিরোধী ইতিহাস- ব্যাখ্যার অংশ হয়ে দলটির সদস্যদের কাছে ইতিহাস জটিল হয়ে ওঠে, কেউ না কেউ ইতিহাস খেলে বলে মনে হয় কিন্তু এত বড় জাল ছিঁড়ে কে নায়ক বনবে? কে হবেন যোগ্য কর্নেল তাহের? অথবা কর্নেল তাহেরই কি সেই আরাধ্য নায়ক যাকে দেশ খুঁজে পায়নি? অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের নায়কেরা ও খলনায়কেরা, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নায়কেরা ও খলনায়কেরা, মুক্তিযুদ্ধের পরের নায়কেরা ও খলনায়কেরা কি তাদের পরিচয়ে স্থির থেকেছেন? এসব প্রশ্ন অবধারিত। সবাই না হলেও অনেকেই আসেন মঞ্চে, চলে যান। মঞ্চের বাইরে থাকেন কেউ থিয়েটারের ভাষা এভাবে তৈরি হয়।
মূল কথা সময়। সামষ্টিক সময়। একটি দল যেমন দেশের সংকটকে মূর্ত করে, দেশও তেমনি বিশ্বের বাইরের নয়। একটি কাল কাউকে নায়ক হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়, আবার কালই পথ ভেঙে ফেলে। এক কাল অতিক্রান্ত হলে সেই কালের ব্যাখ্যা দাঁড় করায় মানুষ। নায়ক ও খলনায়ক বেছে নেয় তারাই।
ক্রাচের কর্নেলও একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেয়েছে যেটা ধ্রুব ব্যাখ্যা নয়, একটি ব্যাখ্যা। আমাদের ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখার দায়ও আমাদেরই।’
অন্যদিকে, লেখক শাহাদুজ্জামান বলেন,“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নাটকীয় কালপর্বকে উপজীব্য করে লেখা প্রামাণ্য উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল’। এই গ্রন্থে আমি বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ক্রান্তিকালটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছি কর্নেল তাহের নামের একাধারে অমীমাংসিত, বিতর্কিত এবং বর্ণাঢ্য চরিত্রের মাধ্যমে। উনিশশ ষাট সত্তর দশকের পৃথিবী যখন পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক দুটো শিবিরে বিভক্ত তখন তৃতীয় বিশ্বের অগনিত তরুণ-তরুণী একটি বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ছিল বিভোর। কর্নেল তাহের সেই প্রজন্মের তরুণ। তিনি একটি বিশেষ ধারার বিপ্লবী রাজনীতির কৌশল হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবহিনীতে, তারপর দুঃসাহসিক এক অভিযানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্ধর্ষ এক অপারেশনে হারিয়েছেন একটা পা, ক্রাচে ভর দিয়ে তারপর নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্যতিক্রমী এক সেপাই অভ্যুত্থানের এবং অবশেষে শিকার হয়েছেন উপমহাদেশের ঘৃণিত এক রাজনৈতিক ফাঁসির। একটা আদর্শকে তাড়া করতে গিয়ে একজন মানুষ যতটুকু দিতে পারে দিয়েছেন সবটুকুই। যদিও সে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু তথাকথিত বহু সাফল্যের চাইতে কোনো কোনো ব্যর্থতাও হয়ে উঠতে পারে উজ্জ্বল, দাবি করে আমাদের মনোযোগ। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চায় কর্নেল তাহের সচরাচর থাকেন উহ্য, উপেক্ষিত অথবা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ধোঁয়াচ্ছন্ন।
একজন লেখক হিসেবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক হিসেবে এই ব্যতিক্রমী মানুষটিকে নিয়ে একটি সাহিত্যিক মোকাবিলার ফল ‘ক্রাচের কর্নেল’। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এই দেশে কর্নেল তাহেরকে ঘিরে থাকা নানা কুয়াশা সরিয়ে তার সঠিক ঐতিহাসিক বয়ানটি নির্মাণ করা দুরূহ কাজ। দীর্ঘ গবেষণায় সেই কালপর্ব সংক্রান্ত দলিল, লেখাপত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কর্নেল তাহেরের রক্তমাংসের অবয়ব এবং তার যাত্রাপথটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছি এই গ্রন্থে। অনুসন্ধান করবার চেষ্টা করেছি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনে বেড়ে ওঠা একজন স্টেশন মাস্টারের ছেলে আবু তাহের কি করে একদিন ফঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করলেন, ‘জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে।’একটি স্বাপ্নিক প্রজন্মের নিঃসঙ্গ বলি কর্নেল তাহের। কিন্তু শুধু সাফল্য বা ব্যর্থতায় নয় কর্নেল তাহের আমি দেখি তার আকাঙ্ক্ষার ভেতর। বাংলাদেশের ইতিহাস নানা ক্রান্তির ভেতর দিয়ে চলেছে। আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বার্থেই আমাদের ইতিহাসের, রাজনীতির আলোয় ছায়ায় থাকা প্রকাশ্য, প্রচ্ছন্ন নানা চরিত্র, ঘটনাকে আমাদের খুঁড়ে দেখা প্রয়োজন নানা বিতর্ককে বিবেচনায় রেখেই। ক্রাচের কর্নেল তেমন একটা প্রয়াস। এ শুধু এক কর্নেলের গল্প নয়, এ গল্প জাদুর হাওয়া লাগা আরো অনেক মানুষের, নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের, ঘোর লাগা এক সময়ের।
ক্রাচের কর্নেল যখন লিখেছি তখন এর মঞ্চ সম্ভাবনার কথা ভাবিনি। এই প্রামাণ্য উপন্যাসে যে ব্যাপক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অগণিত চরিত্র, জটিল, সর্পিল রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বয়ান আছে তাকে মঞ্চের ভাষায় তুলে আনা এক দুরূহ কাজ বলেই মনে হয়েছে। সাহিত্যের পাঠক পাঠিকার তার নিজের মর্জি মাফিক ঘটনা, চরিত্রের কল্পনা করে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকে কিন্তু তাকে এক নির্দিষ্ট দৃশ্যভাষায় মঞ্চে উপস্থাপন নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, অভিনেত্রীর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। ‘বটতলা‘ নাট্যদল সেই দুরূহ চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে জেনে চমৎকৃত হয়েছি। এই নাট্যদলের সব কলাকুশলীকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভ কামনা। বটতলার ধারাবাহিক অর্জনের পথ ধরে ‘ক্রাচের কর্নেল’-এর একটি সফল মঞ্চায়ন করবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”