ভালোবাসার মানুষের জন্য যেকোনো কিছু : হৃতিক
‘মনের সঙ্গে যুদ্ধে আমি হৃদয়ের কথাই শুনি। আমি কখনোই ভয় পাই না, কারণ আমি হাল ছাড়ার মতো মানুষ নই। পরাজয় কী—সেটা আমার ভুলে যেতে হয়, কারণ আমি বিজয় উদযাপনেই অভ্যস্ত।’ প্রতিটি কথায় আর শব্দে যেন ঠিকরে পড়ছে যোদ্ধার আত্মবিশ্বাস। সুপারস্টার হৃতিক রোশন তো একজন যোদ্ধাই। কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পরোয়া করেননি কখনোই। পরাজয় বিষয়টি তাঁর কাছে নাকি নেহাত কাল্পনিক! ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভুগতে হয়েছে তাঁকে, তবে সেটা মোকাবিলা করেছেন; এবং করে চলছেন সাহসিকতার সঙ্গে। পেশাদার জীবনের কারণেই অনেকবার শারীরিক ইনজুরির সম্মুখীন হয়েছেন, সেগুলো পারও করেছেন দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে। ‘অপরাজেয়’ হৃতিকের এই তীব্র জীবনস্পৃহা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বি টাউনের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘ফিল্মফেয়ার’ ধরেছে আলাপচারিতার আতশকাচ।
প্রশ্ন : আপনার জীবনটা যেন রোলারকোস্টার রাইড...
হৃতিক : জীবন তো আসলেই রোলারকোস্টার রাইড। এটা অনবরত ওঠানামা করবে। মুহূর্তে মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত সব বাঁক আর ঝাঁকুনির মধ্য দিয়ে যাবেন আপনি। কিন্তু হিসাব একটাই, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যত ইচ্ছা চেঁচান, আওয়াজ করুন আর উপভোগ করুন। আপনিই বলুন, শামুকের মতো ঢিমেতালে কি আর রোলারকোস্টার রাইড হয়?
প্রশ্ন : আপনার মস্তিষ্কে সার্জারি হয়েছে। ইনজুরিতে পড়েছেন অনেকবার, এমনকি আপনাকে এও বলা হয়েছে যে আপনি হয়তো আর হাঁটতে পারবেন না...
হৃতিক : তা ঠিক, ‘কাইটস’ ছবি করার সময় ওসব ঘটনা ঘটে। আমার মনে হলো যে আমি হয়তো আর ছবিটি করতেই পারব না, কারণ আমার হাঁটুর ব্যথা দুই বছর হয়ে গেলেও সারছিল না। এমনকি মাস ছয়েক ক্র্যাচ ধরেও চলাফেরা করেছি। সে সময়েই আমি শেষ ছবি হিসেবে ‘গুজারিশ’-এ সাইন করি। কারণ, চিকিৎসকরা বললেন যে আমার হাঁটু আর কখনোই ঠিক হয়ে উঠবে না। আমার তখন বয়স ৩৫। তাঁরা বললেন, আমার হাঁটু এরই মধ্যে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। ঠিক করে হাঁটার জন্য আমার হাতে নাকি আর মাত্র এক বছরই আছে। এটাই পরিণতি, এর থেকে কেবল আরো খারাপই হতে পারে। বিষয়টি শুনে মনে হলো, আমি যেন নরকে চলে গেছি। নিজের কথা ভেবে আমি প্রচণ্ড বিষণ্ণ হযে পড়লাম। আমি আর আমার দুই ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পারব না, ওদেরকে বিএমএক্সের স্টান্ট শেখাতে পারব না। এমনকি আমি তখন একটা পিয়ানোও কিনে ফেলেছিলাম। যদি আর অভিনয় করতে না পারি, অন্তত গান গাওয়ার চেষ্টা করব। তবে যা-ই হোক, আমি হাল ছেড়ে দিইনি। আমি অন্য রাস্তা অবলম্বন করেছি, খুঁজেছি। চীন, ফিনল্যান্ড, এমনকি সিঙ্গাপুরে গিয়ে আমি যত ধরনের ভিন্ন পদ্ধতির থেরাপি আছে, সবই প্রয়োগ করেছি আমার হাঁটুটা সারিয়ে তোলার জন্য। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে, একটানা দুই বছর। এভাবেই একদিন, হঠাৎ করেই যেন ব্যথাটা মিলিয়ে গেল!
প্রশ্ন : এটা কড়া নিয়মানুবর্তিতা আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার পরিচয় দেয়, তাই না?
হৃতিক : তা তো অবশ্যই, আপনার তো অ্যাকশনটা নিতে হবে। যেকোনো বিপত্তি পেরোনো সম্ভব, যদি আপনি চান। আমার হাঁটুর ব্যথা আর নেই, এতে আমার চিকিৎসকরা পর্যন্ত তাজ্জব! তাঁদের কথা, আমি নাকি বিজ্ঞানকেও হারিয়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন : ভয়ের সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কেমন?
হৃতিক : ভয় কেবলই কল্পনা। কাজেই কোনো কিছু যদি আজকের দিনে ঠিকঠাক না হয়, তাহলে আমি অতীত থেকে শিক্ষা নিই আর সেটা প্রয়োগ করি এখনকার সমস্যায়। আমার সামনে যে ‘ভয়’ অপেক্ষা করে, সেটা এমনি কেটে যায়। এটা একবার করতে পারলেই আপনার মন এটার একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলবে। জীবনে অনেক কিছু নিয়ে অনেক রকমের ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। নতুন নতুন ভয় যখন সামনে আসবে, তখন আপনি আরো বেশি ভীত হয়ে উঠবেন। কিন্তু একবার যদি পুরো ব্যাপারটার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আপনার মনে গেঁথে যায়, তখন আপনি সব সময়ই পরিস্থিতিকে কাটিয়ে ওঠার রাস্তা খুঁজে পাবেন। ওই প্যাটার্নটাই আপনাকে রাস্তা বাতলে দেবে।
প্রশ্ন : দুই যুগ আগে কি আপনি ভাবতে পেরেছিলেন যে আপনাকে এত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে?
হৃতিক : তেমনটা আসলে ভাবিনি। বিষয় হলো যে সুখী থাকাই আসল ব্যাপার। যে ফুয়েল পাইপটা আপনাকে অনবরত বেঁচে থাকার রসদ জোগায়, সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আপনি কী করবেন? মন খারাপ করে চুপচাপ বসে থাকবেন আর নিজেকে অসুখী বলবেন, কারণ আপনার পাইপটি কাটা পড়েছে! এটা তো আপনি করতে পারেন না। আপনি কাউকে আসলে দোষও দিতে পারেন না। কাজেই আপনার অবশ্যই অন্য কিছু করতে হবে। একটা পাইপ কাটা পড়েছে তো কী হয়েছে, আরো পাইপ তৈরি করুন, যা আপনাকে জীবনে চলার জ্বালানি জোগাবে।
প্রশ্ন : গত পাঁচ বছরের মধ্যে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী?
হৃতিক : ‘কারণ’ হয়ে ওঠা, ‘প্রভাব’ নয়। যখনই আপনি ‘প্রভাব’ হয়ে উঠবেন, তার মানে হচ্ছে আপনি কোনো একটা কিছুর শিকার হলেন। আপনার চারপাশের পরিস্থিতিকে আপনি পাত্তা দিচ্ছেন। এতে আপনার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আপনি মাথায় ঢোকাচ্ছেন মনগড়া গল্প। তখন জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্যের সঙ্গে আপনার চিন্তাভাবনা আর মিলবে না। আমাদের সবার জীবনেই একটা বৃহত্তর লক্ষ্য রয়েছে। জীবনযাপনের লম্বা পথের মাঝেই আপনি একে খুঁজে পাবেন।
প্রশ্ন : আপনাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা সবাই বলেন যে আপনি হলেন সবচেয়ে বিনয়ী তারকা...
হৃতিক : বিনয় ভালো জিনিস। কিন্তু এটা আবার অনেকে অনেকভাবে ‘ব্যবহার’ করতে চায়, কারণ অনেক সময় ‘বিনয়’ খুব ‘কাজে’ দেয়! এ ধরনের ছলনা আমি ভালোই টের পাই, এর ফলাফলও আমার জানা। আমার কথা হলো আমি যা, আমি তাই। আমি এমন মানুষ, যে কি না ভালোবাসার মানুষের জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত সব সময়।