থমথমে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল, ৫৫ পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকাল বন্ধ
‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হলে সাত দিনের জন্য দেশের সব কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে’, তৈরি পোশাক মালিকদের এমন হুঁশিয়ারির মধ্যে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায়। আজ মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আরও তিনটি বেড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫। এর মধ্যে ৯টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিল্প পুলিশ আশুলিয়া জোনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম।
শিল্পাঞ্চলে এক হাজার ৮৬৩টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্য চলমান সংকটের আগে থেকেই বন্ধ ছিল ১৬৭টি কারখানা। নতুন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ৫৫টিসহ ২২২টি শিল্প কারখানা বন্ধ থাকায় গভীর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন তৈরি পোশাক শ্রমিকরা।
হা-মীম গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, স্টারলিংক, আল মুসলিম, অনন্ত গ্রুপের মধ্যে বৃহৎ কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় এই খাতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা। বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ হারানোর পাশাপাশি রপ্তানি বাজারে বড় ধরনের প্রভাব তৈরির আশঙ্কা তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের।
ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ এবং হাজিরা, টিফিন, নাইট বিল বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে গত তিন সপ্তাহ ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায়।
গত সোমবার থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হা-মীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়ার লিমিটেড, এ্যাপারেল গ্যালারি লিমিটেড, রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড, এক্সপ্রেস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেড, নেক্সট কালেকশন লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেয়। ‘নিরাপত্তার অভাব’ দেখিয়ে তাদের অনুসরণ করে অন্য কারখানাগুলোও একই সিদ্ধান্ত নিলে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় শিল্পাঞ্চলে।
শ্রম আইনের ১৩/১ ধারায় যে কারখানায় অসন্তোষ দেখা দেবে, সেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নীতি, অর্থাৎ কাজ না করলে সেদিনের মজুরি না দেওয়ার ঘোষণাও হয়। ফলে কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় একদিকে তৈরি পোশাক খাতের যেমন বিপর্যয় নেমে এসেছে তেমনি শ্রমঘন এই এলাকার একটি বড় অংশের শ্রমিকরা কোনো বেতন-ভাতাও পাবেন না।
এমন প্রেক্ষাপটে গত সোমবার রাতে তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সাধারণ সভায় ‘কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হলে সাত দিনের জন্য সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
গত মাসের শেষদিকে হঠাৎ করেই শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে দেশের প্রধান এই রফতানি খাত। এরপর শ্রমিক, মালিক, সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সেনাবাহিনী, এমনকি স্থানীয় রাজনীতিবিদ সবাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরতে পারেনি কারখানাগুলো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাঠে নামানো হয় যৌথবাহিনী। কারখানায় হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগে ১৫ জনেরও বেশি আটক হলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি।
তৈরি পোশাক মালিকদের অভিযোগ, শিল্প পুলিশ আগের মতো সক্রিয় নয়। বিশেষ করে তারা কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে শিল্প পুলিশ আশুলিয়া জোনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম বলেছেন, আগের মতো ভাবলে এখন চলবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগের মতো অ্যাকশনে যাবার সুযোগ নেই। আমি স্পষ্টভাবে বলছি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিপেটা আর জলকামান দিয়ে সমবেত শ্রমিকদের হয়তো ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ বাইরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব আমাদের। আর শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ বিষয় দেখার দায়িত্ব মালিক পক্ষের। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টার ফলে এখন পর্যন্ত কোনো কারখানায় অতিতের মতো জ্বালাও-পোড়াও পরিস্থিতি হয়নি।
সমস্যার সমাধানে মালিক-শ্রমিকদের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান পুলিশ সুপার সারওয়ার আলম।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি বলেই আমরা কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’