আলফ্রেড হিচকক, এক বিস্ময়ের নাম!
যাঁরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে আলফ্রেড হিচকক অপরিচিত কেউ নন। রহস্য এবং আলফ্রেড হিচকক, দুটোই যেন একে অপরের সমার্থক। যাঁরা চেনেন না, তাঁদের জন্য খুব সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
পুরো নাম আলফ্রেড জোসেফ হিচকক। একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। জীবদ্দশায় তিনি পঞ্চাশটির অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সবাক ও নির্বাক দুই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সফলতা পেয়েছেন। তাঁর চলচ্চিত্রের প্রধান উপাদান ‘রহস্যময়তা’। এই রহস্যময়তাকে ঘিরে তিনি নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সেই সঙ্গে থ্রিলিং, সাসপেন্স ছবির পথ প্রদর্শকও তাঁকে বলা হয়।
এবার আসি হিচককের চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা প্রসঙ্গে। শুরুতেই উল্লেখ করেছি তিনি একজন নান্দনিক নির্মাতা। এ অংশে তাঁর চলচ্চিত্রের নন্দনত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। এরপর কয়েকটি চলচ্চিত্রের আলোকে তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয় দেওয়া হবে।
বিশ্ব চলচ্চিত্রে আলফ্রেড হিচকক নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। এই ধারা তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের কাহিনীতে বজায় রেখেছেন। উদ্বেগ, ভয়, ভীতি, টান টান উত্তেজনার সংমিশ্রণ যেন প্রতিটি ফ্রেমে খেলা করত। এ রকম কাহিনী আর ক্যামেরাওয়ার্ক দিয়ে তিনি ঠিকই দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সে কারণেই তাঁকে ‘দ্য মাস্টার অব সাসপেন্স’ বলা হয়।
হিচকক ব্রিটেনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাতা। ‘ব্ল্যাকমেইল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯২৯ সালে ব্রিটেনে সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু করেন। এরপর একেক করে তিনি সাইকো, ফ্যামেলি প্লট, ভার্টিগো, নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্ট, নটোরিয়াস, রোপ, রিয়ার উইন্ডোসহ বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন। নিজের চলচ্চিত্রের ব্যাপারে হিচককের নিজস্ব কিছু মতামত ছিল। তাঁর মতে, ‘আমি চলচ্চিত্রের গল্প এমনভাবে সাজাই যা দেখে দর্শক যেন দোটানায় ভোগে। নাটকীয়তা বাদে চলচ্চিত্র একদম প্রাণহীন।’
‘সাইকো’ চলচ্চিত্রটি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, হিচকক নিজের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটি একটি মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনির গল্প। ছবির গল্পে দেখা যায়, মেরিয়ন ক্রেনের ৪০ হাজার ডলার চুরির মাধ্যমে ছবির রহস্যের শুরু হয়। মেরিয়ন তাঁর বয়ফ্রেন্ডের ঋণের টাকা শোধ করার জন্য অফিসের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নিজেকে আত্মগোপন করার জন্য। এভাবেই মূলত ছবির কাহিনী উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দোটানার মধ্য দিয়ে এগোয়।
হিচককের মতে, ‘সাইকো’ একটি কমেডি সিনেমা। কমেডি সিনেমা হলেও তিনি কমেডির মোড়কে ব্যতিক্রমী কিছু উপস্থাপন করেছেন। ওখানেই তাঁর মুনশিয়ানা।
‘রোপ’ হিচককের রহস্যঘেরা ছবির আরেকটি উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউসমাস্টার রুপার্টের দেওয়া ‘আর্ট অব মার্ডার’ লেকচারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় ব্রান্ডন। সেই থেকে তার মনে খুন করার প্রবণতা জাগে। একসময় সে তাঁর সহপাঠী ডেভিডকে খুন করে। এই কাছে ব্রান্ডনের সঙ্গে ছিল বন্ধু ফিলিপ। ডেভিটের লাশকে লুকিয়ে রাখা হয় একটি এন্টিক বাক্সে। তারপর তারা পার্টির আয়োজন করে। যেখানে দাওয়াত করা হয় ডেভিটের বাবা, আন্টি, প্রেমিকা, আর সেই হাউসমাস্টারকে। যে বাক্সে ডেভিডকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটিকে বানানো হয়েছিল ডিনার টেবিল। এভাবে শুরু হয় ভয়াবহ স্নায়ুযুদ্ধের খেলা।
সিনেমার এমন সব কাহিনী নিয়ে খেলা করা হিচকককে করেছে সবার থেকে আলাদা। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই একেকটি ‘মাস্টারপিস’। তাঁর চলচ্চিত্র, নির্মাণকৌশল অনেক বিখ্যাত পরিচালকদের পথ দেখিয়েছে। যদিও একটা সময় তাঁর চলচ্চিত্রের নিজস্ব দর্শনতত্ত্ব সমালোচকরা ইতিবাচকভাবে নেয়নি। কিন্তু একটা সময় পর তিনি আর চলচ্চিত্রের দর্শন সর্বত্র সমাদর পেতে থাকে। হিচককের এই ধারা আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। যদিও হিচককের কপালে খুব একটা পুরস্কার জোটেনি। আবার এটা ঠিক, পুরস্কার কোনো ছবির ভালো মন্দের মাপকাঠি হতে পারে না।
তিনি শুধু কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, একজন সুলেখকও বটে। টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় প্রথম লেখা ‘গ্যাস’। একই বছর প্রকাশিত হয় ‘দ্য ওমেন পার্ট’। এ ছাড়া ‘সরদিদ’, অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো’-এর মতো লেখাও তিনি লিখেছেন। তাঁর সর্বশেষ লেখা ছিল ‘ফেডোরা’। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, হিচককের লেখাগুলো মূলত নারীকেন্দ্রিক। তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রের কাহিনীও আবর্তিত হয়েছে নারীকে ঘিরে।
যাইহোক প্রতিভাবান আলফ্রেড হিচকক ইংল্যান্ডের লন্ডনে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় ছেলেসন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর স্কুল এবং কলেজ ছিল জিসুইট ক্লাসিক স্কুল সেন্ট ইগনাতিয়াস কলেজ ও সালেসিয়ান কলেজ। তাঁর মা ও পিতামহী ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত।
১৯২০ সালের দিকে এসে আলফ্রেড হিচকক আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রের প্রতি। তিনি লন্ডনে ফিল্ম প্রোডাক্টশনে কাজ করা শুরু করেন। প্যারামাউন্ট পিকচারের লন্ডন শাখায় তিনি টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর তিনি ‘ইসলিংটন স্টুডিও’তে কাজ করেন। এরপর টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতেই আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রপরিচালক হিসেবে।
দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়াতে তিনি ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে রানি এলিজাবেথের কাছে তিনি নাইট উপাধি লাভ করেছিলেন।
আলফ্রেড হিচকক ছিলেন বিস্ময়কর নির্মাতা। খুব কম মানুষ আছেন যাঁরা এরকম প্রতিভা নিয়ে জন্মান। বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে তাঁর নাম কখনো মলিন হবে না।