ব্লু হোয়েল : বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন স্বর্ণার মা
‘আমার মেয়ের তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না। সে যখন যা চাইত, তাই দিতাম তাকে। তবে কেন মারা গেলি রে মা? কী দোষ করছিলাম আমরা? একবারের জন্য বলেও গেলি না রে মা।’
এভাবেই কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলতে বলতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন রাজধানীর ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার মা সানি বর্ধন।
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের বাসা থেকে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর আগে সে সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত ছিল বলে বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে সবার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে।
স্বর্ণার যে ঘরে মৃত্যু, সেই ঘরে বসেই মেয়ে সম্পর্কে এনটিভি অনলাইনকে স্বর্ণার বাবা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তখনই পাশের ঘর থেকে মেয়েহারা মায়ের বিলাপ এভাবেই শোনা যাচ্ছিল।
স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী একটু পর পর মেয়ের কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তাকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা বা সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
‘আমি একজন আইনজীবী। আমার মেয়ে চলে গেছে। কিন্তু আমার একটা ছেলে রয়েছে। তাই আমাকে শক্ত থাকতে হচ্ছে। কারণ, আমি বেশি ভেঙে পড়লে আমার ছেলেটার কী হবে? আমার অনেক ক্লায়েন্ট রয়েছে, যাদের মামলাগুলোর ভার আমার হাতে। তাদের কী হবে?’
কথাগুলো বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান সুব্রত। একটু পর ফিরে এসে বলেন, ‘সরি, আমার স্ত্রী বেশি পাগলামো করলে আমি ছাড়া কেউ তাকে আটকাতে পারে না। তাই একটু পরপর তাঁর কাছে আমাকে যেতে হচ্ছে।’ এর পর তিনিও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্বর্ণার বাবা আরো বলেন, ‘আমার মেয়ের মুখে কোনোদিন আমি এই গেমটির নাম শুনি নাই। কিন্তু মারা যাওয়ার দিন আমি এ সম্পর্কে শুনি। বাসায় ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে, মনে হয় স্বর্ণা ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত ছিল। আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই, যখন যেটা চাচ্ছে তখন সেটাই পাচ্ছিল। আমি তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখি নাই। কেবল লক্ষ করতাম যে রাত জেগে সে ফোন ব্যবহার করত। আর কিছুদিন থেকে ও শুধু ছাদে যেতে চাইত।’
সুব্রত আরো বলেন, ‘ছাদে ও একা একা ঘুরত। এমনকি হঠাৎ হঠাৎ করে ওর ছাদে যাওয়ার নেশা উঠত। বলত, পাপা কী সুন্দর আকাশে চাঁদ উঠছে, চলো ছাদে যাই। রাত ১১টার পর অনেকবার আমি নিজেই তাকে ছাদে নিয়ে গেছি। পূর্ণিমার চাঁদ তার খুব পছন্দ ছিল।’
বৃহস্পতিবারের ঘটনা নিয়ে সুব্রত বলেন, ‘স্বর্ণার ঘরের লক লাগানো থাকত না। ওই দিন ভোর ৬টার দিকে ওর মা ঘুম থেকে ওঠার পর তার রুমের লক লাগানো দেখতে পায়।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পরে সে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। এর পর দরজা একটু খুলেই মেয়েকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় নাইলনের ওড়নায় পেঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখে ওর মা। আমি গিয়ে দেখি, খাটের ওপর একটি চেয়ার পড়ে আছে। চেয়ারটি খাটের পশ্চিম পাশে নিচে পড়লেই কাজের মেয়েটি জেগে উঠত। তা যাতে না হয় এবং কোনো শব্দ যাতে না হয়, সে জন্য বিছানার ওপর ফেলা হয়েছে চেয়ারটি।’
‘আমি দ্রুত ওড়না কেটে মেয়েকে নিচে নামিয়ে খাটের ওপরে শুইয়ে দিই। ওর জিহ্বা বের করা ছিল, আর চোখগুলো কেমনভাবে যেন তাকানো অবস্থায় ছিল। আর এই ওড়না আমি সিঙ্গাপুর থেকে কিনে এনেছিলাম।’
একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুব্রত। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মেয়ে সাজতে অনেক পছন্দ করত। ও একটি ওড়না চেয়েছিল, যা ও সব ড্রেসের সঙ্গে পরতে পারবে।
আমি সিঙ্গাপুর থেকে ওই ওড়না এনে দিই। ওই ওড়নাতেই সে চিরতরে চলে যাবে এমন জানলে কখনোই আনতাম না ওই ওড়না।’