থিয়েটারকর্মী অন্ধকারে পথ হারায় না : রুমা মোদক
মঞ্চনাটক দিয়েই পরিচিত পেয়েছেন রুমা মোদক। তবে শুরুটা হয়েছিল কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকের সঙ্গে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি ছোটগল্পও লিখেছেন। মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এনটিভি অনলাইনের জন্য রুমা মোদকের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লেখক অঞ্জন আচার্য।
প্রশ্ন : সম্প্রতি নাট্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকার জন্য নাট্য সংগঠন ‘থিয়েটার’-এর পক্ষ থেকে ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক’ পেয়েছেন। ওই বিষয় নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। অনুভূতি কেমন?
রুমা মোদক : অগ্রণী ভূমিকার জন্য কি না জানি না। থিয়েটার চর্চার স্বীকৃতি পেয়েছি। থিয়েটার প্রবর্তিত 'মোহম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক' প্রাপ্তি বলা যায় ২০ বছর অবিচ্ছিন্ন থিয়েটার চর্চার অর্জন। ভীষণই অনুপ্রেরণামূলক এই অর্জন এবং ভীষণভাবে দায়বদ্ধতারও। তবে আমি কিংবা আমার দল ‘জীবন সংকেত’ সব সময়ই থিয়েটার চর্চা করি একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। কেবলই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে থিয়েটার প্ল্যাটফর্মকে আমরা নিইনি। আমাদের দলীয় স্লোগান ‘নাটক হোক গণচেতনার হাতিয়ার'। থিয়েটার চর্চার শুরু থেকেই আমরা কী আঙ্গিকে, কী বিষয়ে আমরা অনুগামী হয়েছি গৌরবময় ঐতিহ্যের। পলিটিক্যাল কন্সাসনেন্সজাত সমকালীন সংকট ও উত্তরণ খোঁজার প্রয়াস শুরু থেকেই ছিল।
এই পুরস্কার স্বীকৃতি অনুপ্রাণিত করে এবং তার চেয়েও বেশি দেয় পরিচিতি। সত্যিকার অর্থে আজ যে কাজের জন্য আমি পুরস্কৃত, এ কাজ তো ২০ বছর ধরে অব্যাহতভাবেই করছি। বলতে পারেন, পুরস্কার অর্জনের ম্যাচিউরিটি প্রয়োজন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের বাস্তবতা এই, যে সব মূল্যায়ন প্রচারকেন্দ্রিক এবং সে প্রচারও হতে হয় রাজধানীমুখী।
আমি আনন্দিত এ জন্য যে ঢাকার বাইরে প্রচারের পাদপ্রদীপের সেন্ট্রালাইজড আলোর বাইরে থিয়েটার এই মূল্যায়নটুকু করেছে।
প্রশ্ন : নাটকের প্রতি এই যে টান, এটা কখন-কীভাবে শুরু হলো?
মোদক : থিয়েটার দেখার টান অনেক দিনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যাস্ত আইনের চোখ রাঙানি মাথায় নিয়ে বেইলি রোডে প্রথিতযশা সব নাট্যদলের উল্লেখযোগ্য সব প্রযোজনা দেখেছি। আর নিজে জড়িয়েছি, নিজ জেলা শহরে এসে। এখানে একদল থিয়েটার পাগল যুবক, যাদের সঙ্গে জুটে গেলাম আমিও। নাটক রচনায়, নির্দেশনায়, অভিনয়ে। এখন তো জীবনসঙ্গী পুত্র-কন্যাসহ থিয়েটারেই বসবাস। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা আমার জীবনসঙ্গী অনিরুদ্ধ কুমার ধর শান্তনুর। জীবন-জীবিকা বিপন্ন করা এমন থিয়েটার-পাগল মানুষের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করে মুহূর্তের জন্য থিয়েটার বিচ্ছিন্ন হওয়া অসম্ভব।
প্রশ্ন : বর্তমান বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের অবস্থা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোদক : বাংলাদেশের মঞ্চে এখন প্রচুর কাজ হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করছে দলগুলো। কী নাট্যভাষ্য রচনায়, কী নির্দেশনায় নানা বৈচিত্র্যে অক্লান্ত কাজ হচ্ছে। এর সবই যে মানসম্পন্ন হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু এ এমন এক শিল্পমাধ্যম, যেখানে রাষ্ট্রীয় সামান্যতম পৃষ্ঠপোষকতা নেই। বলা বাহুল্য, আগের মতো ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সহায়তা নেই। করপোরেটের লাভের হিসাব যেখানে একেবারেই মিলে না, ফলে তাদের ও সুদৃষ্টিবঞ্চিত। আমাদের সেই বলিষ্ঠ শিল্পমাধ্যমটি কেবল টিকে আছে কিছু মানুষের ভালোবাসায়। ধারদেনা করে দলগুলো চলছে, প্রযোজনা মঞ্চে আনছে, থিয়েটারের উৎসব করছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই। এ দেশের এসব প্রযোজনাই বিশ্বের নানা ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রিত হচ্ছে, যাচ্ছে, প্রশংসিত হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে থিয়েটারের কাছে?
প্রশ্ন : দেশের সার্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে থিয়েটার কতখানি ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনি মনে করেন? নতুন প্রজন্মের কাছে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাই বা কতটুকু বলে আপনি অনুভব করেন?
মোদক : প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া কঠিন। কিছুটা আপেক্ষিকও বটে। কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া আপনি যদি প্রশ্ন করেন দেশের সার্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কী ভূমিকা রাখতে পারছে, তবে প্রশ্নটিই কি যৌক্তিকতা হারায় না? ক্রিকেট খেলায় কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট হচ্ছে, জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর কী ভূমিকা প্রশ্নটি ওঠানো যায়? বলতে পারেন, তবে কি পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গেই সব লেনদেন, হিসাব-নিকাশ? আমি বলব, না। থিয়েটার নিজেই এমন একটি শিল্পমাধ্যম, স্ব-সমাজ ও স্ব-সংস্কৃতির কাছে তার অনিবার্য দায়বদ্ধতা। আমাদের দেশে এখনো থিয়েটারই একমাত্র শিল্পমাধ্যম, যেখানে অপসংস্কৃতি গ্রাস করেনি। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাবিরোধীদের এখানে কোনো স্থান নেই। থিয়েটার স্বেচ্ছাসেবী, দলগত কাজে উৎসাহিত করে। থিয়েটারকর্মী অন্ধকারে পথ হারায় না। থিয়েটারের যা কিছু অবদান, সবটুকুই তো ইতিবাচক এই সমাজে। আর নতুন প্রজন্মের কথা যদি বলি, সর্বত্রই এক অস্থিরতা। হঠাৎ অপ্রস্তুত অচেনা বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার অস্থিরতা। এর ছাপ কোথায় নেই, গানে চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে কোথায় নয়? থিয়েটারেও পড়েছে। তবে হাজার বছরের শিকড়ে জনমানুষের মাঝ থেকে যে শিল্পমাধ্যমের উৎপত্তি ও বিকাশ সে শিল্পমাধ্যম অবলুপ্ত হলে জাতির আত্মপরিচয় ও অবলুপ্ত হবে।
প্রশ্ন : একটা বিষয় লক্ষ করা যায়, শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে শিক্ষা-চিকিৎসা সবই রাজধানীকেন্দ্রিক। এই যে কেন্দ্রীভূতকরণ অবস্থা, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মোদক : এটা ভীষণই বেদনাদায়ক ব্যাপার। হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন, এটা শুধু থিয়েটার কেন—শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে শিক্ষা চিকিৎসা সব রাজধানীতে সেন্ট্রালাইজড। সুযোগ, সুবিধা, মূল্যায়ন সবকিছু। আমাদের মনোজাগতিক গঠনও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিবেচনা করে, সে হোক চেতনে কিংবা অবচেতনে। আমাদের নাটক মূল্যায়ন হয়—মফস্বলের নাটক যে বোঝাই যায় না, এভাবে। সাহিত্যচর্চা করতে গিয়েও দেখেছি, মফস্বলবাসী জানলেই অনেকে উন্নাসিকতা দেখান। শিল্প-সাহিত্যের মান নয়, কোথায় হচ্ছে, কে করছে সেটা বিবেচ্য হয়। মোটেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কাজ যাই করি, ভালো কিংবা মন্দ রাজধানীর পাতে না উঠিয়ে দিলে তার কোনোরকম মূল্যায়ন আশা করা যায় না। আমার মনে হয়, এ সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার দায় এবং দায়িত্বও এখন আমাদেরই। আমরা ভালোবেসে কাজ করি, রাজধানীর উন্নাসিকতাকে ইগনোর করার দৃঢ়তা আমাদের থাকা উচিত।
প্রশ্ন : মোটাদাগে দেশের আমজনতার মাঝে একটা প্রবণতা দেখা যায়, ঢাকাতেই যেন সব ভালো কাজ হচ্ছে, অন্যত্র তেমনটা নয়। এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ তুলে ধরছি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত নিম্নমানের দৈনিক পত্রিকাকেও দেখা যায় ‘জাতীয় পত্রিকা’ উপাধি লিখতে। অথচ ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত উন্নত মানের পত্রিকাকে হেয় অর্থে বলা হয় ‘মফস্বলীয় পত্রিকা’। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার নাট্যদল হবিগঞ্জের ‘জীবন সংকেত’ও একইভাবে মূল্যায়িত হয় বা হচ্ছে। একজন নাট্যকর্মী হিসেবে এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মোদক : এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা আগের উত্তরে হয়তো বলা হয়েছে। কাজ দিয়ে প্রমাণ দিতে হয়, যে শিল্প এবং সাহিত্যের মফস্বল বলে কিছু নেই। ২০০৭-এ ঢাকার মঞ্চে যখন আমার রচনা এবং সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় 'বিভাজন' নাটকটি মঞ্চায়িত হয়, ঢাকার প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছিল, ঢাকার বাইরেও ভালো নাটক হয়। এটা ছিল স্বীকার করে নেওয়া মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। আর এখন হাতের মুঠোয় পৃথিবী। এখন কোনো জায়গাকে অবস্থানগত কারণে মফস্বল বলা রীতিমতো অন্যায়। তবে এই যে আমাদের কারো কারো অভিভাবকসুলভ বিবেচনা তার কিছুটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। মাঠে নেমেই বিচারক হওয়া কাম্য। ড্রয়িংরুমে বসে নয়।
প্রশ্ন : পেশায় আপনি একজন শিক্ষক। সেইসঙ্গে গল্প নিয়ে কাজ করছেন অনেক দিন ধরেই। পাশাপাশি নাট্যচর্চায় নিবেদিত আছেন। কীভাবে সমন্বয় করেন পেশা, লেখালেখি ও নাট্যচর্চাকে?
মোদক : হ্যাঁ, শিক্ষকতা পেশা। পেটের দায়। আর বাকিটা তো ভালোবাসার জায়গা। কম্প্রোমাইজ করে নেই নিজের আনন্দের জন্য, তৃপ্তির জন্য। যথেষ্ট সময় পাই না বলে অতৃপ্তিও যথেষ্ট। আরো বেশি পড়া এবং লেখার তৃষ্ণা সবসময় পীড়িত করে।
প্রশ্ন : গল্পকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন? অর্থাৎ আপনার চোখে ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী? আপনার গল্পভাবনা জানতে চাই।
মোদক : এই প্রশ্নটা তো আমার জন্য উত্তর দেওয়া খুব কঠিন মনে হচ্ছে। গল্প লিখি, যখন লিখি তখন কিন্তু কোনো তত্ত্ব মাথায় রাখি না। একটা গল্প আমার ভেতরে জন্ম নেয়, প্রকাশের তাড়া দেয়। আমি লিখি, আঙ্গিক, প্রকাশভঙ্গি নিয়ে ভাবি। এই আঙ্গিক প্রকাশভঙ্গি সবটুকুই যা বলতে চাই তা বলতে পারছি না, পারব কি না সেই দৃষ্টিকোণ থেকে।
পাঠক পড়বে কি না, পড়ল কি না তাও ভাবি তবে এটা সর্বোচ্চ বিবেচনায় থাকে না। তবে লেখক হয়ে উঠতে হয় কিছু নিজস্ব স্বকীয়তায়। আমি আমার সময়ের বিশ্বস্ত ভাষ্যকার হয়ে উঠতে পারি, কিন্তু এই সময়ের সংকট থেকে উত্তরণের আভাস কিংবা ভিন্ন ব্যাখ্যা যদি আমার গল্পে না থাকে তবে তা ইতিহাসের ধারাবিবরণী হয়ে যাবে। আমি মনে করি, এই চেষ্টাটুকু লেখকদের সচেতনভাবে করা উচিত। আমি নিজের বেলায় সব সময় তাতে সক্ষম হই না। কিন্তু লক্ষ্যটা সেদিকে রাখি। ব্যর্থতা আমার সীমাবদ্ধতা।
প্রশ্ন : তরুণ গল্প-লিখিয়ে ও তরুণ নাট্যকর্মীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
মোদক : ওরে বাবা! তরুণদের পরামর্শ দেওয়ার মতো ম্যাচুরিটি আমি অর্জন করেছি বলে মোটেই মনে করি না। আমি নিজেই এখনো পরামর্শ প্রত্যাশা করি। তবে সাহিত্যকর্মী কিংবা নাট্যকর্মী সবার প্রতি একটা অনুরোধ রাখতে পারি। যে ক্ষেত্রেই কাজ করি, কিছুটা সময় রাখতে হয় শেখার জন্য। আর প্রতিনিয়ত যেতে হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওয়ার্কশপের মধ্যে দিয়ে। আত্মপ্রকাশের তাড়া থেকে প্রজন্ম নিজেকে একটু দূরে রাখতে শিখুক।
প্রশ্ন : বর্তমানে কী লিখছেন, আসছে বইমেলায় কোনো বই আসছে কি?
মোদক : হ্যাঁ, বইমেলায় জেব্রাক্রসিং প্রকাশন থেকে তৃতীয় গল্পগ্রন্থ 'গোল' আর চৈতন্য থেকে 'মুক্তিযুদ্ধের ৩টি নাটক' নামে একটি নাট্যসংকলন আসার কথা রয়েছে।