লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস : নৈরাজ্য ও যৌনতায় বিপ্লবের উপপাদ্য
“আমার শক্তি, তীব্র কামনা, আগ্রাসন; সবটাই আমি কেবল আমার কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে পারি। আমরা সবাই একই সাথে ড. জেকিল এবং মি. হাইড। আমাদের প্রেতাত্মাকে আমরা চিনি, কিন্তু এ নিয়ে কাউকেই; এমনকি আমাদের সঙ্গীদেরও কিছু জানাই না। এই প্রেতাত্মার সাথেই আমরা জীবন কাটাই, তাকে জীবনের গহীনে ঢেকে রাখি। যখন জেকিল হাইডে রূপান্তরিত হয়, তখন আমি সিনেমা পর্দায় ফুটিয়ে তুলি সেই সব প্রেতাত্মাদের।”
-বার্নার্দো বের্তোলুচ্চি, ১৯৭৭
সত্তরের দশক। এক্সপ্লয়টেশন ঘরানার চলচ্চিত্র যখন দুনিয়াজুড়ে সিনেমাপর্দায় পাইকারি হারে যান্ত্রিক তথা বিনোদনমূলক যৌনতা আর নেহাত আরোপিত সহিংসতা উৎপাদন করে চলছিল, সে সময়টাতেই বড়সড় এক ধাক্কা খেল চলচ্চিত্রের ইতিহাস। নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পর্দা পড়বার রাত; ১৪ অক্টোবর, ১৯৭২। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ স্তম্ভিত করে দিল তামাম তাত্ত্বিক, ফিল্ম বোদ্ধা কিংবা দর্শক- সবাইকে। আদিম কিংবা সহিংস যৌনতার বেপরোয়া চিত্রায়ণ, বিখ্যাত চলচ্চিত্র বিশ্লেষক পলিন কেলের ভাষ্যমতে- চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মিত অন্যতম শক্তিশালী ইরোটিক সিনেমা; অথচ যার ন্যারেটিভ মোটেও যৌনতার অভিনব চিত্রায়ণ কিংবা পরীক্ষণের পটভূমিতে আটকে নেই, উদ্দেশ্যও যেন যৌনতা প্রদর্শনের খোলনলচেতে বন্দি নয়। হয়তো বিপ্লব, হয়তো ক্ষোভ বা হতাশাকে ছুড়ে ফেলা, কিংবা বেশুমারি আবেগ যেখানে আরোপিত কোনো চিত্রায়ণ নেই। দেখালেন বার্নার্দো বের্তোলুচ্চি, দেখালেন মার্লোন ব্র্যান্ডো। চলচ্চিত্রের খেরোখাতায় ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ শিরোনামায় লেখা হয়ে গেল এক বিপ্লবের গল্প।
শুধু সে সময়ের বলে নয়, ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ শুরু থেকেই বহুল বিতর্কিত চলচ্চিত্র হিসেবেই ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যুক্ত হয়ে গেছে। সহিংস, অপ্রত্যাশিত কিংবা ‘শকিং’ যৌনতার চিত্রায়ণই কেবল তার কারণ নয় অবশ্যই। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ সরাসরি অস্বীকার করার প্রয়াস দেখিয়েছে সব কিছুকে। সমাজ কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, বুর্জোয়া ব্যবস্থাপনা কিংবা যাপিত জীবনের স্থূল নীতি-নৈতিকতার সীমানা- সব কিছুকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে ব্র্যান্ডো-বের্তোলুচ্চির ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’। এই বিদ্রোহ আর আর পর্দায় এই বেপরোয়া বহিঃপ্রকাশ নিয়ে বের্তোলুচ্চির ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় এ কথাগুলোয়-
‘একা একা কথা বলা আমার পছন্দের নয়, আমি নিজেও এটা করি না। আমি নিজের জন্য কথা বলি না, বুঝিয়ে দেই। এভাবেই, আমার সিনেমা বাস্তবতাকে মোড়ক খুলে দেখে, দেখায়; সেই সাথে এটা দুনিয়াকে ঠিকঠাক বুঝবার একটা মাধ্যম হয়ে ওঠে। আমার মনে হয়, এটা নির্মাতা আর দর্শক- দুয়ের জন্যই সুবিধাজনক।’
-বার্নার্দো বের্তোলুচ্চি, ১৯৭৩
‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ বাস্তবতা থেকে পালাতে চাওয়া এক মানুষের আখ্যান। ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় মিলিয়ে লেখা স্ক্রিপ্টের এই সিনেমাতে প্রোটাগনিস্ট পল (মার্লোন ব্র্যান্ডো) যৌনতাকে জীবনের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। পল আদতে আমেরিকান হলেও বসবাস করে প্যারিসে, স্ত্রীর মৃত্যুতে (আত্মহত্যা) তার মধ্যে বিশেষ কোনো শোক বা কষ্ট আপাত চোখে দর্শকের নজরে পড়ে না। অর্থহীন বাস্তবতা থেকে পলায়নরত পলের এক ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে দেখা হয় ফরাসি তরুণী জেনের সাথে, তাঁরও ফ্ল্যাট দরকার। অতর্কিত আগ্রাসনে পল জেনের সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়, একে অপরকে বিন্দুমাত্র না জেনে- এমনকি নাম জানা ছাড়াই। জেন পলের নাম জানতে চাইলে পল তীব্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং বোঝাতে চায় যে যৌনতাই এই অ্যাপার্টমেন্টে অর্থবহ এবং প্রয়োজনীয়, বাইরের দুনিয়ার কোনোকিছু এমনকি নামও এখন অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। এই অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে যা আছে তার সবকিছুকেই পল অস্বীকার করতে চায়, অন্তঃসারশূন্য মনে করে। স্বাভাবিক জীবনে তাদের আচরণ দর্শক দেখতে পায়, তারা পায় না। সেখানে পল তার মৃত স্ত্রীর মালিকানাধীন হোটেলে ফিরে যায় আর ডাকসাইটে কর্নেলের মেয়ে জেনকে দেখা যায় বাগদত্তা টমের সাথে, যে কি না জেনকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করবে বলে তাকে নিয়েই বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা বানাচ্ছে। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ ছবির সাথে সাথেই এই সিনেমার শুটিংও চলতে থাকে, একইসাথে জেন এবং পল আবার মিলিত হয় অ্যাপার্টমেন্টে। এই পরস্পরবিরোধী অথচ সমরৈখিক বাস্তবতার নিরীখেই অগ্রসর হতে থাকে সিনেমার মধ্যে সিনেমাওয়ালা সিনেমা; ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস-এর গল্প।
পল, প্রায় পুরো সময়টাতেই এমন কোনো আশ্রয় হাতড়ে বেড়ায় যেখানে সে তার অতীত, যন্ত্রণা, পুরনো পরিচয়; এমনকি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যেতে পারে। পলের চিন্তাগুলো রুগ্ণ- তাদের অর্থহীনতা, অন্তঃসারশূন্যতা, প্রয়োজনহীনতা, পুনরাবৃত্তি এবং দুনিয়ার সীমারেখায় অর্থবহ কোনো কিছু করতে পারার অক্ষমতাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়; পোড়াতে থাকে পলকে। তার মনস্তত্ত্বের সাথে মেলানো যায় হেনরি মিলারের বায়োগ্রাফিক্যাল উপন্যাস ‘ট্রপিক অব ক্যান্সার’এর গল্পকথকের সাথে; জাগতিক জীবনের সব কিছুকেই যার অভিশাপ, গালি দেওয়া বা ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। স্ত্রী রোসার মৃত্যু পলকে স্বীয় চেতনা কিংবা দর্শনের গহীনে ডুব দেওয়ার এক বিচিত্র প্রয়োজন ঠাউরে দেয়। দর্শকেরও কোনো অবস্থাতেই এ বোধ কাজ করে না যে পল তার স্ত্রীর অভাববোধ করছে, কিংবা স্ত্রীর মৃত্যুতে আত্মদহনে ভুগছে। অথচ, চমকপ্রদভাবে; পলের আত্মপীড়া বা অনুশোচনার তীব্র বহিঃপ্রকাশের মূল কারণ রোসার মৃত্যু বা আত্মহত্যা। রোসা মৃত, এটাই পলের যাবতীয় কষ্টের বা হতাশার একক কারণ নয়- অনেক বিস্তৃত।
অসুখী দাম্পত্য জীবন, জাগতিক জীবনে প্রবঞ্চনা কিংবা রোসাকে রক্ষা করতে না পারা- এমন বহু অনুশোচনার সামষ্টিক তীব্রতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতেই পল ভুলে যেতে চায় সবকিছু। জীবন, পৃথিবী, বাস্তবতা, ঈশ্বর, প্রেম, সমাজ; এমনকি নিজের নামও।
১.
ব্যক্তি পল যেমন একজন নাস্তিক এবং নিহিলিস্ট, বিচিত্রভাবে সে মৃত্যু কিংবা ঈশ্বরের ভয়ে ভীতও। পলের এই বিচিত্র আচরণ মনে করিয়ে দেয় ‘দ্য ইউজুয়াল সাসপেক্টস’ সিনেমার অন্যতম চরিত্র কিটিংয়ের কথা " I don't believe in God, but I'm afraid of Him ". সুতরাং, পল অনবরত মৃত্যুকে কামনা করলেও নিজেকে শেষ করবার মতো সাহস তার একেবারেই নেই। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এই অক্ষমতা আর নিরন্তর আত্মদহন পলকে একজন সোশিওপ্যাথিক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে, তার চারপাশের সব কিছুকে ধ্বংস ও অস্বীকার করার জন্য তাড়না জোগায়। কিন্তু পল একজন চিন্তাশীল মানুষ আর সেই চিন্তাশীলতার দহনেই সে জ্বলন্ত। তাই এই তাড়নাকে সে মেটাতে চায় ভিন্ন মাধ্যমে, আঙ্গিকে, প্রেক্ষিতে।
নাস্তিক এবং নিহিলিস্ট, এহেন বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি পল তীব্রভাবে কামপ্রবণ একজন মানুষ। যাপিত জীবনের অর্থবহতা নিয়েও তার চিন্তাধারা গভীর। হতাশা আর ক্ষোভে জ্বলতে থাকা পলের যৌন তাড়না বা কামনার বহিঃপ্রকাশ কখনোই সুশ্রী, সুখপ্রদ বা মোলায়েম হওয়া সম্ভব নয়। পর্দায় তার যৌন আচরণের বহিঃপ্রকাশ তাই তীব্র, বিক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক। এ আচরণ দর্শককে সুখপ্রদ বা শিল্পিত যৌনদৃশ্য অবলোকনের ভয়্যারিস্টিক সুখানুভূতি থেকে বঞ্চিত করে, কিন্তু যৌনতার বহিঃপ্রকাশে পলের উদগ্র, জান্তব, বাস্তবিক, ‘অনস্ক্রিন’ আগ্রাসন দর্শককে তার অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত করে। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলা চলে, পলের এহেন যৌন আচরণ অনেকটা তেমনই যেমন ‘সিনেমা নোভো’য় আমরা ‘ক্ষুধা’কে দেখতে পাই; যেভাবে গ্লবার রোচা ‘ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব’ বা ‘অ্যান অ্যাসথেটিক অব হাঙ্গার’-এ বলেছেন-
“...ক্ষুধার্ত মানুষের স্বাভাবিক আচরণই হবে সহিংসতা, আর তার জন্য এহেন আচরণ মোটেও আদিম মনোবৃত্তির পরিচায়ক নয়...”
একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মতোই, জীবনের প্রতি তীব্র হতাশা, ক্ষোভ আর আক্রোশে জ্বলতে থাকা পলের সহিংস যৌন আচরণ তাই অস্বাভাবিক নয়, বরং অনেকটাই সহজাত। এই সহজাত, কিন্তু বিক্ষুব্ধ যৌন আচরণ কেবল তার কামনা নিবৃত করবার তাগিদ নয়; একইসাথে নিজেকে সর্বোচ্চ শক্তিধর হিসেবে উন্মোচিত করার এবং তার জীবন ও আত্মপরিচয়ের অন্তঃসারশূন্যতাকে ধ্বংস করবার অভিপ্রায়। বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন অ্যাপার্টমেন্টে আত্মগোপন করা পলের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, জেনের জন্য নয়। এই বিচ্ছিন্ন আস্তানায় পল স্বীয় যৌন আক্রোশ ও আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করার পাশাপাশি জেনকে শারীরিক ও মানসিকভাবে করায়ত্ত করতে চায়। পলের ভূমিকা এখানে অনেকটা শয্যায় কর্তৃত্বপরায়ণ তীব্র কামক্ষমতাধর রগচটা কড়া আমেরিকান পুরুষের মতো- কারণ সেটাই তার কাছে একমাত্র গণ্য করবার মতো বিষয় বা সত্য। এই ভূমিকা পালনের জন্য যৌনসঙ্গী নয়, পলের দরকার ছিল যৌন প্রতিদ্বন্দ্বী; যাকে পীড়ন, নিয়ন্ত্রণ বা পরাস্ত করার মাধ্যমে পল নিজেকে প্রমাণ করবে। জেন, পলের যৌন তৎপরতার কাছে সরাসরি পরাস্ত, কামজর্জরভাবে আচ্ছন্ন এবং দাসত্বের শিকার। এই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা যৌনকর্তৃত্বের মধ্য দিয়ে পল একইসাথে নিজেকে ভুলে যাওয়ার কিংবা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে থাকে।
২.
জেনের (মারিয়া স্নেইদার) ভূমিকা বা চরিত্র রূপায়ণ ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এর আরেক চমকপ্রদ দিক। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস-এর আগে অন্য কোনো সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেননি মারিয়া স্নেইদার; বয়সেও তিনি অতটা বড় নন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন আনকোরা ও ফুটন্ত- কি বহির্জগতে কি সিনেমাহলের পর্দায়। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এর জেন চরিত্রটি ঠিক তেমনই। জীবনবোধ বা পার্থিব দুনিয়ার ক্রুর অভিঘাত তখনো তাকে স্পর্শ করে উঠতে পারেনি। সহজ কথায়, একেবারেই পলের বিপরীত। তার এই পবিত্রতা কিংবা অপাপবিদ্ধ, আনকোরা আচরণ ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ এনে দেয় ভিন্ন আঙ্গিক। এ কারণেই ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে আগ্রাসী, আগন্তুক পলের যৌন আক্রমণ আগ্রাসনে সে স্তম্ভিত হলেও কোনো প্রতিবাদ করে না, বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তাতে সাড়া দেয়।
পলের বিচিত্র ‘নামহীন পরিচয়ে কেবলই যৌন সম্পর্ক’ তার কাছে কোনো সমস্যা, অসঙ্গতি বা অপরাধের বোধ তৈরি করে না। পলের আচরণে বা কথায় সে পর্যুদস্ত, কিন্তু সেটাকে উপভোগ করার মধ্যে দিয়েই ‘স্মলটাউন গার্ল’ জেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে প্যারিসের পরিণত, জীবন ও যৌন বোধের বৈচিত্র্যের দীক্ষায় দীক্ষিত নারী। এর স্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায় বাগদত্তা টমের প্রতি তার আচরণ এবং ব্যবহারের বিবর্তনে। টমের সাথে প্রথম দেখায় টমের ‘চলচ্চিত্র নির্মাণ’- সংক্রান্ত বিষয়ে অসহায়ের মতো আচরণ করে জেন, কিন্তু পরের ধাপে দেখা যায় জেন নিজেই ক্যামেরার সঞ্চালন কিংবা ন্যারেটিভের অগ্রসরতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
সেলফ রিফ্লেক্সিভিটি কৌশলের এই অভিনব প্রয়োগ কেবল টমকেই নয়, সাথে দর্শককেও বিভ্রান্ত ও আচ্ছন্ন করে তোলে। বহির্জগত ও অ্যাপার্টমেন্টের রিয়্যালিজমের মাঝখানে যে সূক্ষ সীমারেখা টানা, তা এর মাধ্যমে আরো জটিল করে তোলা হয়। একপর্যায়ে, সিনেমার দরকারি শট বাদ রেখেই জেন ছুটে চলে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে, যা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় জেন নিজের ইচ্ছাকে বা নিজের মনমত চলার ক্ষমতাকে কতটা স্পষ্টভাবে উপভোগ এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে।
পলের মতো জেন পরিচয় সংকট বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা মানুষটি নয়। সুতরাং, এই অসম অথচ উপভোগ্য লড়াইয়ে আদতে জয়ী হয়ে উঠতে থাকে জেন। তিন দিন বাদে শোকে কাতর, হতাশ পল যখন আত্মপরিচয়ের মুখোমুখি হয়ে ট্যাঙ্গো নাচের পার্টিতে জেনকে বাস্তবিক জীবনে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়; জেন তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে শেষমেশ। সবশেষে ধাওয়া করতে থাকা পলকে হত্যা করে জেন অবলীলায় পলের সাথে পরিচয়কে পুলিশের কাছে অস্বীকার করে, সিনেমা সেখানেই শেষ হয়- এই অসম লড়াইয়ে জেনের কাছে পলের সার্বিক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।
৩.
চলচ্চিত্র রসায়নের চূড়ান্ত রূপায়ণই বের্তোলুচ্চি দেখিয়েছেন ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ। সেট ডিজাইনিং বা সাউন্ড এফেক্ট থেকে বিভিন্ন রং কিংবা আলোর ব্যবহার, সবখানেই অর্থবহতা রয়েছে। বিষয়গুলো এখানে কেবল ন্যারেটিভের প্রয়োজনে আটকে থাকেনি বরং এগুলোর ব্যবহার এবং উপস্থাপন সরাসরি নতুন অর্থবহতা সুষ্টি করেছে।
বের্তোলুচ্চি চিত্রকর বেকনের কাজে প্রভাবিত ছিলেন। সিনেমার টাইটেল সিকোয়েন্সে বেকনের দুটো পেইন্টিংও দেখা যায়। বেকনের অনেক চিত্রকর্মেই কার্ভ লাইনের ব্যবহার দেখা যায়, পলের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের ডিজাইনেও এই কার্ভ লাইনের আঙ্গিকে স্থাপত্য দেখা যায়। টাইটেল সিকোয়েন্সের পেইন্টিংয়ে চেয়ারে বসা নিঃসঙ্গ ব্যক্তির অবয়ব আমরা ভেতরেও দেখতে পাই, যখন পল অ্যাপার্টমেন্টের রুমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে চেয়ার রাখার নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া, বিশেষভাবে বলা যেতে পারে কাঁচের দেয়াল কিংবা গ্লাস এফেক্ট ব্যবহারে বের্তোলুচ্চির মুন্সিয়ানা। অরসন ওয়েলস, পিটার গ্রিনওয়ের মতো অস্তিত্ববাদী চলচ্চিত্রকারদের বেশ
পছন্দসই উপকরণ গ্লাস এফেক্ট; ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ শুরু থেকেই বের্তোলুচ্চি সেট ডিজাইনিংয়ে প্রচুর ব্যবহার করেছেন এই মাধ্যম। তবে, ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস-এ এর ব্যবহার দর্শককে সরাসরি কোনো কিছু নির্দেশ করে দেয় না; বরং এর সৌন্দর্য আর রহস্যময় ব্যবহারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত- অনেকটা বলা যেতে পারে, আচ্ছন্ন করে তোলে। কিন্তু আসলে কি এর কোনো মানে নেই? অবশ্যই আছে, তবে তা স্পষ্ট নয়- গাঢ় রহস্যে ঘেরা।
৪.
ছবির শুরুর দিকের দৃশ্যে পল (তার সাথে দর্শকও দেখে) অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলার জানালার কাঁচে ব্রিজের ওপর দিয়ে সশব্দে চলতে থাকা ট্রেনের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। পলের বা দর্শকের দৃষ্টিকোণ এখানে সরাসরি উন্মুক্ত, শব্দের ব্যবহারও এখানে ডাইজেটিক- অর্থাৎ, আরোপিত কোনো কিছুই নেই। এর একটু আগেই (ওপেনিং শটে) প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে থাকা ট্রেনের শব্দে তিতিবিরক্ত পলকে দেখা যায় চিৎকার করে ঈশ্বরকে গালাগাল করতে- এখান থেকে দর্শক শুরুতেই জাগতিক দৃশ্য বা শব্দের প্রতি পলের মনে জমে ওঠা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর আক্রোশের হদিস পায়। একইসাথে, অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলার জানালার কাঁচে চলন্ত ট্রেনের প্রতিফলন আর শব্দ পলের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মানসিকতাকেই নির্দেশ করে।
দ্বিতীয় তলা থেকে ক্যামেরা টিল্ট ডাউন করে নিচ তলাতে, প্রধান দরজার সামনে আসতেই পুরো দৃশ্যপট আমূল বদলে যায়। তরুণী জেন সেখানে অস্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা সিংহদরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এখানে কাঁচের দরজার ভেতরে কী আছে তা দেখা যায় না, যা জেনের অপরিপক্ব মানস ও অনভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করে। আবহ সঙ্গীতও এখানে ধ্রুপদী ধাঁচের মিউজিক তথা নন-ডাইজেস্টিক, যা সামগ্রিক অর্থে জেনের অপাপবিদ্ধতা কিংবা ফুরফুরে মানসিক অবস্থাকে নির্দেশ করে। টেলিফোন বুথে (অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঘেরা) মায়ের সাথে কথা বলবার সময় দরজা দ্রুত সরে যায় ক্যামেরার লক্ষ্যপট থেকে, সেখানে জেন মোটেও দরজার এই অস্বচ্ছতাকে বরদাস্ত করে না। উত্তেজক ভঙ্গিতে সহজাতভাবে পা ভাঁজ করে রাখা জেনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবয়ব ধীরলয়ে টিল্ট আপ করে দেখানো হয়- তার অনাগত দিনগুলোতে তার এই শারীরিক সৌন্দর্য বা সক্ষমতা একটি মুখ্য বিষয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তার আভাস দর্শক পেয়ে যায়।
গ্লাস এফেক্ট পলের দৃষ্টিকোণ থেকে কখনোই বা কোনো অবস্থাতেই অস্বচ্ছ নয়। যে বাথরুমে পলের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল (পলের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে না তাকে হত্যা করা হয়েছে বিষয়টি স্পষ্ট নয়, কারণ এখানে পুলিশের সন্দেহের কথা বলা হয়েছে), সেটি অস্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা হলেও তার ভেতরে পরিচারিকার কার্যক্রম বা কথাবার্তা- কোনো কিছুই পলের অগোচরে থাকে না। স্বাভাবিকভাবে পল যা দেখতে পায়, দর্শকেরও সেই দৃষ্টিকোণ বা পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কোনোকিছু দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। জেনের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো, অস্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল তার বা দর্শকের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বেশিরভাগ সময়ই ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টির অগোচরে বা অনেকটা রহস্যাবৃত রাখা হয়েছে। পল ও জেনের মধ্যবর্তী অভিজ্ঞতার ব্যবধান এর মাধ্যমে সবসময়ই নির্দেশ করা হয়েছে।
৫.
সাবজেক্টের অবস্থানগত ব্যবধানের মাধ্যমেও ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ বোঝানো হয়েছে ভিন্ন এবং বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় অর্থবহতা। ওপেনিং শটে পলের মাথার ওপর দেখা যায় চলন্ত ট্রেন, যার সশব্দ চালনায় ক্ষিপ্ত পল গালাগাল করতে থাকে ঈশ্বরকে। সিনেমার শেষ শটেও ট্রেনের ক্ষীণ শব্দ বোঝা যায় পলের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে। সিনেমার শুরুতে পল প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা এক হতাশ মানুষ যার কোনো আত্মপরিচয় নেই বা থাকলেও তা সে ভুলে যেতে চায়। শেষ দৃশ্যে পলের আত্মপরিচয় রয়েছে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে জেনকে সে তার ভালোবাসার কথা জানায়- যা নির্দেশ করে তারুণ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পলের যে আত্মপরীক্ষণ, তা সফল হয়েছে। সিনেমার শুরুতে পল ও জেন একে অপরের সাথে পরিচিত নয়, আবার সবশেষে পলকে হত্যা করার পর জেন পুলিশকে জানায় সে পলকে চেনে না- কেবলই তাদের দেখা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো এটি মিথ্যা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সত্যই বটে! কারণ, অ্যাপার্টমেন্টের পলকেই লম্বা সময় (সিনেমার পূর্ণাঙ্গ ব্যাপ্তি সাপেক্ষে) চেনে জেন; আর সেখানে পল বা জেন- কারোরই কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। বহির্জগত বা বাস্তবিক জগতের পলের সাথে অ্যাপার্টমেন্টের পলকে মেলানো জেনের পক্ষে স্বভাবতই সম্ভব নয়। অর্থাৎ, পল ও জেনের প্রথম সাক্ষাৎ ছিল অপরিচিত হিসেবে- যার শেষও হয়েছে অপরিচিত হিসেবেই। সে হিসেবে আমরা দেখতে পাই, সিনেমাটি যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই শেষ হয়েছে কিংবা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখানেই শুরু হয়েছে।
সামগ্রিক অর্থে বিষয়টি সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার বা প্রথার বিরুদ্ধে একটি অসফল বিপ্লবকেই নির্দেশ করে। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এর সামগ্রিক ন্যারেটিভ একটি বৃত্তাকার পথে চলমান, যার শুরু এবং শেষ একই বিন্দুতে এসে ঠেকেছে। শুরুতে প্রৌঢ়ত্বের পথে এগিয়ে যাওয়া পল শেষটায় এসে আত্মপরিচয়কে উপলব্ধি করে তারুণ্যের, তথা মৃত্যুর আস্বাদনে; অন্যদিকে, আনকোরা, শিশুতোষ মানসের জেন শেষ সময়ে অভিজ্ঞ- সে জানে মধ্যবয়স্ক, বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া পলকে কীভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হয়, এমনকি তাকে হত্যার পর অবলীলায় পুলিশের কাছে সবকিছু অস্বীকার করতে হয়।
এই জেন আগন্তুক পলের যৌন আক্রমণে আচ্ছন্ন কোনো সেবিকা বা ভক্ত নয়, এই জেন সিনেমা পরিচালক টমের বাগদত্তা; অভিজ্ঞ বুর্জোয়া ফরাসি তরুণী। অনভিজ্ঞ থেকে পরিণত হয়ে উঠবার পথে এভাবেই জেনকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়।
বয়স কিংবা বার্ধক্য এই সিনেমায় শুরু থেকেই একটি মুখ্য সমস্যা হিসেবে প্রতীয়মান। ওপেনিং শটে ট্রেনের তীব্র আওয়াজে পলের বিরক্তিও তাই প্রকাশ করে, কারণ প্রৌঢ়ত্বের হিসেবে ব্রিজের ওপর সশব্দে চলমান ট্রেন পলের থেকে স্বভাবতই প্রবীণ! এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন প্রথমবার সাক্ষাৎ তথা অপ্রত্যাশিত সঙ্গমের পরে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পল আর জেন বেরিয়ে আসে। এ সময় প্রথমে নিচের রাস্তায় দেখা যায় তরুণী জেনকে, তারপর ক্যামেরা টিল্ট-আপ করলে রাস্তার ওপর ফুটওভার ব্রিজে দেখা যায় মধ্যবয়স্ক পলকে। ফুটওভার ব্রিজের ওপরের ব্রিজে সশব্দে এ সময় আবারও ট্রেন পার হয়ে যায়- অর্থাৎ, এ পর্যায়ে আমরা জেন, পল ও ট্রেনকে মোট তিনটি স্তরে দেখতে পাই। এই স্তরগুলো বয়স বা সময়ের প্রতীক। রাস্তায়, অর্থাৎ সবচেয়ে নিচের স্তরে তরুণী জেন, ফুটওভার ব্রিজ তথা মধ্যবর্তী স্তরে মধ্যবয়স্ক পল এবং তারও উপরে ট্রেন। এই তিন স্তরের ব্যবধান তাদের বয়ঃসীমার ব্যবধানকে নির্দেশ করে, যে ব্যবধান প্রকৃতপক্ষে বাস্তবিক দুনিয়ায় অমোচনীয়।
এই সমস্যা সবচেয়ে প্রকট হয়ে দেখা দেয় বহির্জগতের পলের কাছে, বহির্জগতে জেন ও পলের কথোপকথনেও তা টের পাওয়া যায়। ফ্লপহাউসে প্রবেশরত বয়স্কা যৌনকর্মীটিকে ফেলে যখন তার খদ্দের পালায়, পল তখন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ধাওয়া করে খদ্দেরটিকে। যৌনকর্মীটির প্রতি পলের এই সমব্যথিতার কারণ আর কিছুই নয়, পল নিজেও বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টের রুমে ক্ষমতা বা যৌনতার লড়াইয়ে পল শক্তিধর এবং কর্তৃত্বপরায়ণ। সেখানে সে তারুণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, সেখানে তার নিজের বা অন্য কারো নামটি পর্যন্ত প্রয়োজন নেই; পলের ভাষায়- সেক্স ইজ অল দ্যাট ম্যাটারস! কিন্তু বাস্তবিক পৃথিবীর রাস্তায় পল মোটেও অ্যাপার্টমেন্ট রুমের শয্যায় কর্তৃত্বপরায়ণ, তীব্র কামক্ষমতাধর রগচটা কড়া মার্কিন পুরুষটি নয়, প্রৌঢ়ত্বের পথে এগিয়ে চলা প্যারিসে বসবাসকারী এক মধ্যবয়স্ক মার্কিন ব্যক্তি; জেনের ভাষ্যমতে যে কি না মোটা হয়ে যাচ্ছে, যার মাথার অর্ধেক চুল পড়ে গেছে আর বাকি অর্ধেক চুলও পেকে গেছে! অ্যাপার্টমেন্টে পলের কাছে যৌনতাই একমাত্র গুণবার মতো বিষয়, সেখানে জেনকে ‘পাওয়া’ তার কাছে কেবল সম্ভোগের প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ বা প্রয়োজনীয়।
কিন্তু বাস্তবিক পৃথিবীতে পল অবশেষে জেনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চায় এবং তখন তাদের মধ্যকার বয়স এবং অবস্থানগত পার্থক্য পলের জন্য পীড়াদায়ক বাস্তব এবং সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।
৬.
প্রকৃতপক্ষে, বাস্তবিক পৃথিবীর সবকিছুই ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ সমস্যা হিসেবে প্রদর্শিত। প্রোটাগনিস্ট পলের হতাশা, বার্ধক্য কিংবা অসহায়ত্বই কেবল নয়; জেন কিংবা তার চিত্রপরিচালক হবু স্বামী টম থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই এখানে জাগতিক পৃথিবীর দৈনন্দিনতা কিংবা নিষ্ঠুরতার শিকার। অ্যাপার্টমেন্টের বাড়িওয়ালী এখানে জানে না তার বাড়িতে কে বা কারা ভাড়া থাকে, কখনই বা আসে আর কখনই বা যায়; এমনকি তার কাছে অ্যাপার্টমেন্টের মূল চাবিটি পর্যন্ত নেই।
রোসার মা এখানে অসহায়- মেয়ের শেষকৃত্যের জন্য তার অসহায়ভাবে প্রার্থনা করতে হয় পলের কাছে। রোসার প্রেমিক আর পলকে একটি দৃশ্যে দেখা যায় একই বাথরোব পরিহিত অবস্থায় পাশাপাশি বসে মদ্যপান করতে এবং রোসাকে নিয়ে কথা বলতে। রোসার এই অবৈধ বা অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দেখা যায় না, বরং তারা বিষয়টি নিয়ে বেশ সহজাত আচরণ করে যায়। ফ্লপহাউসে প্রবেশরত যৌনকর্মী বা তার খদ্দের, তারা দুজনেই জাগতিক জীবনের কাছে নিষ্ঠুরভাবে পরাস্ত। খদ্দেরটি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে অসুখী এবং যৌনকর্মীটির বার্ধক্যগ্রস্ত অবয়বের জন্যই তাকে ছেড়ে পালায়, অন্যদিকে বার্ধক্যের শিকার যৌনকর্মীটিরও কেবল পলের কাছে বিচারের জন্য অনুনয় করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
পলও এ পরিস্থিতির কোনো সমাধান করতে সক্ষম হয় না, কেবল খদ্দেরটিকে ধাওয়া করে শেষমেশ প্রহার করা ছাড়া। এ হয়তো আপাত দৃষ্টিতে বিদ্রোহ বা সহিংসতা- কিন্তু এটি কোনো সমাধান এনে দেয় না। জেন বা তার বাগদত্তা টম, তারাও সমস্যাগ্রস্ত এবং তা থেকে উত্তরণের বিশেষ কোনো রাস্তা তারা পায় না।
একদিকে টমের নাটুকেপনা বা সিনেমা নিয়ে বাড়াবাড়িতে জেন বিরক্ত, রেলস্টেশনে দেখা হওয়ার পর টম তাকে যখন জানায় যে তারা চুম্বন করলে বা ভালোবাসার কথা বললে সিনেমার ‘শট’টি ভালো হবে- জেন তখন পার্থিব জগতের ঠুনকো বাস্তবতায় বিরক্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে টমের সিনেমার জন্য জেন কাজ করে গেলেও টমের নির্দেশমতো করতে থাকে না, নিজের ইচ্ছামতো করে যায়- একপর্যায়ে চূড়ান্ত দৃশ্যায়নের কাজ ফেলে রেখেই চলে যায় অ্যাপার্টমেন্টে।
অন্যদিকে, জেনের জন্য টমের (জঁ পিয়্যের ল্যুড) ভালোবাসার কমতি নেই। জেন যখন যেভাবে ইচ্ছা তাকে বা তার কাজকে ফেলে চলে গেলেও টম তাকে বিশেষ জেরা করে না। নিজেদের বিয়ের জন্যই এই বিশেষ ফিল্ম স্বপ্নের মতো করে বানাতে চায় টম; তাদের প্রতি পলের দেখা, কথা কিংবা স্মৃতিকেই এই সিনেমায় স্থান দিতে চায় টম। এটি নির্দেশ করে জেনের জন্য টমের কল্পনা কি পরিকল্পনা কোনোটাই ক্ষণস্থায়ী নয় বরং আজীবনের- কিন্তু তার প্রতি আপাতদৃষ্টিতে জেন বিশেষ কোনো সহানুভূতি দেখায় না। জেনের এহেন আচরণে টম প্রতিবাদ না করলেও অসুখী ও বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে।
৭.
এইসব সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ অ্যাপার্টমেন্ট হলো জাগতিক জীবনের সমস্যা সমাধানের একমাত্র ব্যবস্থা। অ্যাপার্টমেন্টে দর্শক যার জন্য হতাশ পল বা বোকাটে জেনকে দেখতে পায় না- সত্যিকার অর্থে, এখানেই দর্শক পলকে ‘ম্যাচোম্যান মার্লোন ব্র্যান্ডো’ হয়ে উঠতে দেখে, এখানেই দর্শক খুঁজে পায় ‘এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর টি-শার্ট পরা যৌবনদীপ্ত মার্লোন ব্র্যান্ডোকে। একইসাথে তারা জেনকে যেন নয়, সদ্যতরুণী মারিয়া স্নাইদারকে দেখতে পায় তার আকর্ষণীয় শারীরিক গঠনসমেত। অ্যাপার্টমেন্টে বিভিন্ন সময়ে জেনকে পুরোপুরি নগ্নভাবে দেখানো হলেও মার্লোন ব্র্যান্ডোর ক্ষেত্রে সেটি সূক্ষ্মভাবে পরিহার করা হয়। এহেন দৃশ্যায়ন একইসাথে মারিয়া স্নাইদার কিংবা মার্লোন ব্র্যান্ডোকে লাগসই ‘সেক্স-সিম্বল’ হিসেবে দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে।
অ্যাপার্টমেন্ট এখানে আদিম সমাজব্যবস্থারই একটি প্রতীক, যা চলমান সমাজব্যবস্থা কিংবা জাগতিকতাকে পূর্ণাঙ্গভাবে অস্বীকার করতে সক্ষম। সহজার্থে অ্যাপার্টমেন্ট এখানে বের্তোলুচ্চি, পল, জেন এমনকি দর্শকের জন্য একটি ইউটোপিয়ান ইনস্টিটিউশন- যার কাঠামো, ব্যবস্থাপনা কিংবা যৌক্তিকতা যার যার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যাযোগ্য। সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে যৌন-স্বাধীনতা, সহিংসতা বা স্বেচ্ছাচারকে আইনসিদ্ধতা প্রদানই অ্যাপার্টমেন্টের একক কার্যক্রম নয়- বরং বলা যেতে পারে, যৌনাচার বা সহিংসতার বিষয়টি এখানে প্রতীকী।
অ্যাপার্টমেন্ট এখানে বিপ্লবের বা বিদ্রোহের বা অ্যানার্কির সূতিকাগার, পরীক্ষাগার। এখানেই বার্ধক্যের দিকে এগোতে থাকা পল তারুণ্যের দিকে এগিয়ে যায়, অন্যদিকে অপরিণত জেন পরিপক্বতার দিকে। বিপ্লবের জন্য নাম প্রয়োজনীয় নয়, উদ্দেশ্যটাই মুখ্য। যৌনতা, সহিংসতা কিংবা আচরণগত বিকৃতি; যাই বলা হোক না কেন- সেখানে নেহাতই নিয়ামক। সচরাচর বুর্জোয়া ব্যক্তির এহেন বিপ্লবী আস্তানা সইতে পারার কথা নয়, তাই জেনের সাথে অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে আসা টম জানায় তাদের পক্ষে এখানে থাকা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। সম্বিত ফিরলে জেনেরও এই উপলব্ধি হয় যে তাদের যৌথ জীবন এই অ্যাপার্টমেন্টে কাটানো অসম্ভব।
‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’-এ পুরোটা সময়জুড়ে মার্লোন ব্র্যান্ডোর পারফরম্যান্স হয়তো তার জীবনের সেরাটুকু নয়; কিন্তু, যখনই স্ত্রীর সাজানো কফিনে এক হতাশ স্বামী পলকে দর্শক দেখে, সে সময়েই ব্র্যান্ডো দেখান চরিত্রের ট্র্যানজিশন। এমন দুর্দান্ত শো-অফ, হয়তো, পরবর্তীতে কেবল ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’(১৯৭৯) -তেই দেখা গেছে। দর্শকের চোখের সামনে বিপ্লবী, বেপরোয়া ‘মার্লোন ব্র্যান্ডো’ থেকে বাস্তবিক জগতে রোসার শোকে কাতর স্বামী ‘পল’ হয়ে ওঠা। এর পরে ট্যাঙ্গো নাচের সময় বলরুমের পাশের চেয়ারে বসে জেনকে তার ভালোবাসার কথা জানানো।
নিয়মতান্ত্রিক, গ্রামাটিক্যাল ট্যাঙ্গো নাচকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছামতো হাত-পা নেড়ে পুরো আয়োজন আর প্রতিযোগিতাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া ফুর্তিবাজ পল বের্তোলুচ্চির নির্দেশনায় হাত-পা নাড়া বা ডায়ালগ বলা কোনো প্রোটাগনিস্ট নয়- একক এবং অদ্বিতীয় মার্লোন ব্র্যান্ডো। বের্তোলুচ্চির নির্দেশনায় কেবল নয় বরং মার্লোন ব্র্যান্ডোর মধ্যে দিয়ে জন্ম এবং রূপান্তর ঘটেছে পলের। অ্যাপার্টমেন্টের বিপ্লবের সমাপ্তি সেখানেই, এই রূপান্তরের সাথে সাথেই। পল জেনকে জানায় সে তাকে নিয়ে ফ্লপহাউজে জীবন কাটাতে চায়, যা শুনে জেন ঠিক খুশি হতে পারে না।
পলের ভাষ্যমতে, ভালোবাসাই আসল; ফ্লপহাউজে বা দামি টাওয়ারে বসবাস মুখ্য নয়। নাচের প্রতিযোগিতায় নিয়মতান্ত্রিক স্টেপে পা ফেলতে থাকা ঘূর্ণনরত, নাচতে থাকা জোড়ায় জোড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের পল কোনো পাত্তা দেয় না। এ সময়ে নৃত্যরত প্রতিদ্বন্দ্বী আর তাদের দেখতে থাকা দর্শকদের দিকে পল প্যান্ট খুলে উল্টো হয়ে নিজের পশ্চাদ্দেশ উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দেয় বেশ বেপরোয়াভাবে, যা বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তার, কিংবা পরিচালকের সজোরে কষাঘাত। এই বিদ্রোহ বা প্রতিবাদকে মেনে নেওয়া বুর্জোয়া সমাজের জন্য কখনোই সুখপ্রদ ও সম্ভব নয়। ট্যাঙ্গো নাচের প্রতিযোগিতাও তাই পলকে মেনে নিতে পারেনি। আর জেন?
অ্যাপার্টমেন্টে পল বা জেনের কোনো সামাজিক বা অবস্থানগত ব্যবধান নেই, কিন্তু বাস্তবের জেন তো বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থারই প্রতিনিধি! তাই ট্যাঙ্গো নাচের প্রতিযোগিতা থেকেই ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে’ বলে পলকে ছেড়ে চলে যায় জেন। পরিশেষে প্রেম নিবেদনের জবাবে তাকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমেই চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান জানায় জেন। পুলিশের কাছে তার সাথে পরিচয় অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে (‘আই ডোন্ট নো হিম’) বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বিপ্লবকে বা তার সাথে সম্পৃক্ততাকে সরাসরি অস্বীকার করে জেন। ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ কিংবা নামহীন একটি অসফল বিপ্লবের গল্পের পরিসমাপ্তিও এখানেই ঘটে।
৭.
কিন্তু, ব্যর্থতাতেই কি বিপ্লবের চূড়ান্ত সমাপ্তি? জাগতিক মৃত্যুর সাথে সাথেই কি বিপ্লবের মৃত্যু? সেটা কিন্তু শেষমেশ হলফ করে বলা সম্ভব হয় না। মনে রাখতে হয় যে ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ যেখানে শুরু হয়েছে শেষটায় সেখানেই এসে ঠেকেছে, অন্যার্থে যেখানে শেষ সেখানেই শুরু হয়েছে নতুন করে। অ্যাপার্টমেন্ট হয়তো শেষ পর্যন্ত আবাসনযোগ্য হয়নি পল, জেন বা টমের কাছে; কিন্তু অন্য কারো জন্য তো হতেই পারে! কারণ, এর তো কোনো চিরস্থায়ী মালিকানা নেই, এমনকি চাবিও নেই- যে ইচ্ছা চাইলে এসে থাকতে পারে বা চলেও যেতে পারে। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যায়, তাতে নতুন কোনো বিপ্লবের সম্ভাবনাটুকুও রয়ে যায়। নামহীন কোনো বিপ্লবের।