বইয়ের কথা
এক ‘রসগোল্লা’য় হরেক মিষ্টির স্বাদ
বিধান রিবেরু। নামের আগের বিশেষণ হিসেবে লেখা থাকে সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক বা চলচ্চিত্র-সমালোচক। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবেও কলাম লেখেন বিভিন্ন পত্রিকায়। এইসব ভারি ভারি বিষয়ের ভিড়ে তাঁর কবি পরিচিতিটি আড়াল হয়ে গেছে। অনুবাদক, গল্পকার বা অণুগল্প লেখক পরিচিতিগুলোও তেমনই। মিশেল ফুকো, দেরিদা, সার্ত্রে, মার্কস, অ্যাঙ্গেলসের তত্ত্ববিশ্লেষণ থেকে শুরু করে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক নিয়ে যার লেখনী, সেই বিধান রিবেরুর হাতে শিশুতোষ লেখা—এটা যেন অবাক করা বিষয়। তবে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে আসছেন তিনি অনেক দিন ধরেই, যা অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। খুদে পাঠকদের জন্য রচিত সেইসব লেখার সংকলন ‘রসগোল্লা’। অভিধানে এ শব্দটির অর্থ চিনি রসে পক্ব ছানার তৈরি গোল সাদা মিঠাই। ‘রসগোল্লা’ বইটিও তাই। কী নেই এই বইতে? ছড়া, রূপকথা, গল্প, কবিতা, অনুবাদ, নিবন্ধ নিয়ে বিচিত্র ও মজাদার সব বিষয়ের সম্ভার।
একসময় শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘কিশোরবেলা’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিধান রিবেরু। এমনকি শিশুদের চিরন্তন মজার ছড়ার সংকলন ‘আইকম বাইকম’ নামে একটি বইও সম্পাদনা করেছেন তিনি। এসব অজানা তথ্য। বিধান রিবেরুর অজানা অধ্যায়ে এসব লেখা থাকবে হয়তো। যাই হোক, আমরা বরং ‘রসগোল্লা’র স্বাদ আস্বাদন করি। বইয়ের ভূমিকা অংশে লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা : ‘বইটি শিশুকিশোরদের জন্য সাজানো হয়েছে নানা রকমের জিনিস দিয়ে। বইটি নিয়ে তারা যখন বসবে তখন তাদের সামনে থাকবে বিচিত্র স্বাদের লেখা। কাজেই পড়ার আনন্দটা এতে বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। ...আশা করি শুধু শিশুকিশোরদের নয়, বড়দের শিশুমনও এই বইয়ের পাতায় নেচে বেড়াবে আর নির্মল আনন্দ পাবে।’
সেই ভূমিকার সূত্রেই আমরা জানতে পারি, বইয়ে অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলো ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার সংকলন। সূচি অনুসারে বইটি সাজানো হয়েছে যথাক্রমে ছড়া/কবিতা, রূপকথা/লোককাহিনী/গল্প, নিবন্ধ ও ধাঁধা। ছড়া দিয়েই শুরু করি বরং। ‘ঘুমের পরি’ ছড়াটি চিরায়ত রূপকথার আঙ্গিকে লেখা : ‘আঁধার ঘরে তারার মেলা/ আঁকছে তারা কত কী,/ কালপুরুষ, ঢাল তলোয়ার,/ সিংহ রাজা আর ঘটকী।’ ‘ভাত বৃষ্টি’ ছড়ায় উঠে এসেছে মঙ্গাপীড়িত মানুষের হাহাকার : ‘ভাত বৃষ্টি মাগেন তারা/ এথা ইফতার হয় চমৎকার,/ ঈদের দিনেও চাল জোটে না/ বদন লুকান জগৎকার।’
কোনো এক পুটুর চাঁদকে ঘিরে কল্পনার রাজ্যটি ফুটে উঠেছে ‘পুটুর চাঁদ ভাবনা’ ছড়ায় : ‘চাঁদ নিয়ে তার প্রশ্নগুলো, মাথার ভিতর শুরু ঘোরে/ কোথায় গেলে মিলবে জবাব, ভাবনাটা হয় জোরেশোরে।/ পুটুর দারুণ ভালো লাগে, আকাশ দেখতে বাসার ছাদে,/ সবাই বলে, পেলটা কী, ওই রুপালি রাতের চাঁদে।’ ‘স্বপ্নপুরে যাওয়ার আগেই’ ছড়ায় আছে ঘুম ও স্বপ্নের কথা : ‘ঘুরে ঘুরে পাখপাখালি, সবুজ দেখো পাখির চোখে/ ঘুমের ভেতর উড়ছ তুমি চোখটা বুজে দারুণ সুখে।’ ‘তোমায় আমি দিতে পারি’ ছড়াটি চার লাইনে বলা হয়েছে অনেক কথা : ‘একটা করে দুটো করে পাথর কুড়াই ফ্রকটি ভরে/ রঙ-বেরঙের পাথরগুলো রেললাইনে থাকে পড়ে।/ পাথর তো নয়, হীরা পান্না, আমার কাছে মূল্য অতি/ তোমায় আমি দিতে পারি তুমি হলে কোমলমতি।’ ‘মঙ্গলেতে রাজা নাই’ মূলত একটি রাজনৈতিক ছড়া। বাংলাদেশ সরকার একবার প্রচার করেছিল, ভাতের বদলে আলু খাওয়ার জন্য। সেসময় সেটি ব্যাপক সমালোচিতও হয়। এ নিয়েই রচিত হয়েছে এই ব্যঙ্গাত্মক ছড়াটি : ‘দেশের মানুষ পায় না খেতে/ রাজা বলেন, ‘আলু খান/ ভাতের সাথে আলু খেয়ে/ ভাতের ওপর চাপ কমান।’
‘পিঁপড়ে আর মানুষ’ ছড়ায় স্পষ্ট হয়েছে পিঁপিলিকা আর মানুষের মধ্যে তফাৎটি। পিঁপড়ারা দলবদ্ধ এবং সহমর্মী, যা মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। ছড়া থেকেই বরং কয়েক লাইন তুলে ধরছি : ‘শুনেছ কি পিঁপড়ে মরে/ গুলি বোমা তলোয়ারে/ ঢিবির দখল, চর দখলে?’ ‘বৃষ্টিতে ইশকুল’ ছড়ায় বৃষ্টির জন্য স্কুলে যেতে মানা করে মা। তাই মনের ইচ্ছেমতো ছবি আঁকতে বসে বালক। ‘গাছ পাখি ছেলে’ কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে এক নির্মম বাস্তবতার চিত্র। নগরে মাঠগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠছে উঁচু উঁচু দালানকোঠা। খেলার এতটুকু জায়গা থাকে না খেলতে চাওয়া শিশুর। গাছ কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। পাখির এতটুকু আশ্রয়টুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে যেন। ‘শীতে তুমি’ ছড়ায় তুলে ধরা হয়েছে ধনী ঘরের শিশু ও দরিদ্র শীতার্ত শিশুর তুলনামূলক আলোচনা। ধনী শিশুর গায়ে শীতের অনেক কাপড়। আছে বাড়তি আরো অনেক মোটা কাপড়। অন্যদিকে কনকনে শীতে কাঁপে বস্ত্রহীন দরিদ্র শিশু। তবে ছড়াটির শেষে একটি নীতিশিক্ষা দিয়েছেন লেখক : ‘একটা জামা দিলে তোমার/ জীবন রক্ষা হবে/ ওই শিশুটির মনের ভেতর/ তোমার ছবি রবে।’
এডোয়ার্ড লিয়ার (১৮১২-১৮৮৮) ছিলেন একজন খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক ও আঁকিয়ে। তিনি মূলত বিশ্বখ্যাত ছিলেন তাঁর লিমেরিকের জন্য। লিমেরিক হলো এক ধরনের কবিতা। এ অধ্যায়ে লিয়ারের চারটি উদ্ভট লিমেরিক বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক। পাঠের স্বার্থে একটি লিমেরিক তুলে ধরা হলো : ‘এক যে বুড়ো, মুখ ভরা তার দাড়ি/ বলত সে যে, ভেজাল হলো ভারি!/ একটা মোরগ, দুটি পেঁচা/ চারটা চড়াই, দোয়েল, চাচা,/ ভাবে সবাই, দাড়িই মোদের বাড়ি!’
পরের অংশ রূপকথা/লোককাহিনী/গল্প। শুরুর গল্পটি হলো ‘জাদুর জলপাই’। লেখকের ভূমিকার সূত্রে আমরা জানতে পারি এ গল্পের পেছনের গল্পটি : “‘জাদুর জলপাই’ গল্পটির প্রথমে নাম ছিল ‘জলপাই রঙের গাধা’। এটি লিখেছিলাম সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-২০০৯)। লেখাটি সেই আমলেই ছাপা হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান শিশু একাডেমির ‘শিশু’ পত্রিকায়।’ গল্পটি এমন : এক রাজা লোভে পড়ে, এক পরির অভিশাপে অন্ধ ও কালা হয়ে যায়। যার ফলে রাজ্যের প্রজাদের কারোরই দুঃখ-দুর্দশা রাজার চোখে পড়ে না, শুনতে পায় না। এভাবে চল্লিশ বছর ধরে সেই শাস্তি ভোগ করতে থাকে সেই রাজা। রাজার সঙ্গে সঙ্গে কষ্টভোগ করতে থাকে রাজ্যের প্রজারাও। রাজার ছিল অনুগত জলপাই পাহারাদার। রাজার অবস্থা দেখে সে কষ্ট লাঘবে উদ্যোগী হয়। রাজার দুঃখ দূর করার জন্য উপায় খোঁজে। একসময় দেখা হয় এক দরবেশের সঙ্গে। তার কথানুসারে রাজাকে সুস্থ করার উপায় বের করে সে। সাহসের সঙ্গে সে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে একসময় রাজার ভালো হওয়ার ওষুধ (জলপাই) পায়। কিন্তু হাতে কষ্ট-প্রশমনকারী ওষুধ হাতে পাওয়ার পর জলপাই পাহারাদার লোভী হয়ে পড়ে। ভাবে, অন্ধ-কালা রাজাকে সেটি দিয়ে কী হবে, বরং সে নিজেই রাজা হবে। ফলে নিজেই সেই ওষুধ খেয়ে নেয়। খাওয়ার পর পাহারাদার হয়ে পড়ে গাধা। এতে রাজ্যের প্রজারা হট্টগোল শুরু করে। এই পরিস্থিতি দেখে অভিশাপ দেওয়া পরি মাটিতে নেমে আসে। রাজাকে সুস্থ করে তোলে। রাজ্যে আবার সুখ ও শান্তি ফিরে আসে। রূপকার্থে লেখা এ গল্পটি তৎকালীন শাসকদেরই ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা পাঠমাত্রই অনুমিত হয়। শিশুতোষ গল্পের ভঙ্গিতে বলা হলেও, মূলত গল্পটি ভীষণ রকম রাজনৈতিক।
পরের গল্পটির নাম ‘ভূত না ভুল’। হিয়া তার ক্লাসের বন্ধু তিতলীকে মনে করে, সে মানুষ নয়- ভূত। এ নিয়ে সবসময় আতঙ্কে দিন কাটায় হিয়া। নানারকম ‘ভৌতিক’ কাণ্ডকারখানাও ঘটতে থাকে একের পর এক। শুরুতে নিছক ভূতের গল্প বলে মনে হলেও শেষপর্যন্ত এটি মোটেও ভূতের কোনো গল্প নয়। বরং ভূত বলে যে কিছু নেই সেটিই লেখক দেখাতে চেয়েছেন। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হিয়ার ভুল ভাঙায়। সেই সঙ্গে ‘কাকতালীয়’ শব্দটির পেছনের গল্পটিও তাকে শোনায়। কাকের উড়ে যাওয়া ও গাছ থেকে তাল পড়ে যাওয়া যে নিছক একটা ঘটনামাত্র, তাই বলা হয় গল্পের ছলে।
‘রোদ্দুরে এক ফড়িং’ গল্পে লেখক দেখাতে চেয়েছেন পাঠ্যবইয়ের বাইরের প্রকৃতির বিশাল পাঠকে। মৃন্ময়, যার ডাকনাম মিঠু আর বদু, যার ভালো নাম বদরুল হলো স্কুলের মানিকজোড়। একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। মিঠু ভালো ছাত্র। পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলেও বদু অন্যদের থেকে একটু অন্যরকম। তার ভাবনার জগৎটি বিশাল। ক্লাস চলাকালে জানালার বাইরের কাজিপেয়ারার গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। দেখে, ঝাঁ ঝাঁ রোদে গাছের সবুজপাতাগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। সেই পেয়ারা গাছে বসে সাদাকালো দোয়েল। তার মিষ্টি সুর কানে ভাসে বদুর। তাকে টানে সেই স্বাধীন জীবন। কিন্তু তার ঘোর ভাঙে সমাজ-বিজ্ঞানের আনোয়ার স্যারের হুংকারে। সেই স্যার তাকে নয়, বরং তাদের ক্লাসের কাউসারকে (ওরফে কাউ) উদ্দেশ করে এই ডাক দিয়েছিলেন, তখন সবাই ভাবে আজ কাউসারের ওপর ঝড় বইবে। কারণ কাউসার পাঠ্যবইয়ের তলায় রেখে হ্যারি পটারের বই পড়ছিল। কিন্তু আশ্চর্য হলো, ক্ষুব্ধ হওয়ার বদলে স্যার কাউসারকে মৃদু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়। বিষয়টি সবার নজরে বিস্ময়ের মনে হলেও, এ নিয়ে অন্যরকম ভাবতে থাকে বদু। গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক পাঠ্যবইয়ের বাইরের অনন্ত জ্ঞানরাজ্যের বইয়ের কথাটিই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন।
‘মহাকাশে সু ভূতের অভিযান’ গল্পটি বেশ মজার। কেন্দ্রীয় চরিত্র সু, মানুষের সমাজে যিনি মনোবিজ্ঞানী সায়িদ নামে পরিচিত। তার বন্ধু মি, অর্থাৎ ডাক্তার ইভান। সেও ভূত। সায়েন্স ফিকশন আঙ্গিকে লেখা দীর্ঘ এ গল্পটিতে দেখা যায়, কুচক্রী ভূতেরা মহাকাশ দখল করে অপকর্ম করতে থাকে। সেই অবস্থার হাত থেকে রক্ষা করে সু ও মি। তবে গল্পটি ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ শিশু-কিশোরদের জন্য দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। যেমন: কেস হ্যান্ডেল করা, হেলুসিনেশন ইত্যাদি।
‘নীল ঈগল’ গল্পটি রূপকথামূলক। নীল ডানার ঈগল, মানুষখেকো বাঘ। গ্রামের মানুষ ধরে খেয়ে ফেলে হিংস্র বাঘ। তাকে শান্ত করতে চায় ঈগল। কিন্তু বাঘ তাতে রাজি হয় না। একসময় ঈগলের বুদ্ধিতে গ্রামবাসীরা বাঘকে হত্যা করে। এমনকি ঈগলকেও। কারণ তখন চলছিল দুভির্ক্ষ। ফলে ক্ষুধার্ত লোকেদের হুশ ছিল না। ঈগলটিকে হত্যার পর নেমে আসে গ্রামবাসীদের ভেতর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অপরিসীম দুভোর্গ। লোভের জালে আটকা পড়ে সবাই। ঈগলটিকে হত্যা করার সময় তার একটি পালক লুকিয়ে রাখে বিসূ নামে এক ছোট্ট বালক। তার বয়স যখন চল্লিশ হয়, তখন সে সেই ঈগলটিকে স্বপ্ন দেখে। সে-ই একসময় এগিয়ে আসে মানুষের ভেতরকার দুরবস্থা নিরসনে। এখানে চল্লিশ বছরটি গূঢ়ার্থময়।
‘রাজা ও মাকড়সা’ গল্পে শোনানো হয়েছে অধ্যবসায়ের কথা। যুদ্ধে পরাজিত স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস কী করে দ্বীপের মধ্যে তাঁবুর ভেতর লুকিয়ে থাকা অবস্থায় এক মাকড়ার অধ্যবসায়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার যুদ্ধে জয়ী হয়, সেই গল্পটিই তুলে ধরা হয়েছে।
রোমানিয়ার লোককাহিনী ‘অসৎ বণিক’। এক বণিক তার হাজার মুদ্রার থলেটি হারিয়ে ফেলে রাস্তায়। হারানোর পর অনেক খুঁজেও সেটি পায় না। তাই ঘোষণা করে, যে তার থলেটি পেয়ে ফেরত দেবে, সেখান থেকে একশ মুদ্রা উপহার দেওয়া হবে। একসময় সেটি কুড়িয়ে পায় এক কৃষক। মুদ্রার থলেটি ফিরিয়ে দেয় সে। কিন্তু বণিকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষককে পুরস্কার দিতে চায় না বণিক তার অসৎ উদ্দেশ্যে। তবে নিষ্ঠাবান রাজার হস্তক্ষেপে বণিকের সেই ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে। অসততার ফল যে ভালো নয়, সেই শিক্ষাই দেয় এই গল্প।
‘লণ্ঠনবাহী জ্যাক’ আইরিশ লোককাহিনী। পুরোনো বাসনপত্র মেরামত করতো জ্যাক। এক সাধু তাকে তিনটি বর দেয়। আপাতদৃষ্টিতে সেই বর তিনটি মূল্যহীন মনে হলেও, সেগুলোই তাকে নরকে নিতে চাওয়া শয়তানের হাত থেকে পরিত্রাণ দেয়। দরিদ্রদশা থেকে সে ধনী হয়। এ যেন চোরের ওপর বাটপারি। তবে এ গল্পের একটি বাক্য কেমন অস্পষ্ট ঠেকল : ‘শরতের পরই যেমন গ্রীষ্ম আসে হুড়মুড় করে, তেমনি ভালোর পর খারাপও আসে পড়িমড়ি করে।’ শরতের পরে তো গ্রীষ্ম আসে না, আসে হেমন্ত বা শীত। বাক্যে কি শরতের জায়গায় ‘শীতের’ কথা বলতে চাওয়া হয়েছে?
নেপালের লোককাহিনী ‘ভালি ভারো’। ললিতপুরে ভালি ভারো নামে এক লোক থাকত। সে তার বাড়ির একটি ঘরে গোবর জমা করে রাখতো সবার অজান্তে। একদিন ভালির অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কৌতূহলবশে সেই ঘরটি খুঁলে দেখে ঘরভর্তি স্বর্ণ। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে দরিদ্র ভালি-দম্পতি। কিন্তু তারা লোভে পড়ে না। উৎসব করে সেগুলো তারা বিলিয়ে দেয় সাধারণের মাঝে। সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করার এ অনন্য শিক্ষণীয় গল্প।
নেপালের আরেক লোককাহিনী ‘শঠে শাঠ্যং’। ভক্তপুর ও পাটান অঞ্চলের দুই রাজার দ্বন্দ্ব নিয়ে এ গল্প। তাদের পারস্পরিক হিংসা ও ঈর্ষার ফলে প্রজাদের কী করে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তাই তুলে ধরা হয়েছে এ গল্পে। গল্পটি পড়ে সেই প্রবচনটি মনে পড়ে : রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।
‘কুকুর শিয়াল সিংহ’ গল্পটিও নেপালের লোককাহিনী। রম্য এ গল্পটিতে দেখা যায়, কুকুর ও শিয়াল তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ভুল করে সিংহের গুহায় নিজেদের ডেরা করে। তবে সিংহকে নিজের গুহায় ফিরে আসতে দেখে তারা ভয়ে গুহার ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। একসময় শিয়াল ও কুকুরের চালাকিতে তাদের প্রাণরক্ষা পায়, সিংহও পালায়। যাকে বলে, শেয়ালের চালাকি।
‘ক্রাইম রিপোর্টার জেরিন’ একটি দীর্ঘ গল্প। গল্পটি মূলত কিশোরদের উপযোগী করে লেখা। এর মূল চরিত্র সাংবাদিক জেরিন আক্তার। রহস্যঘেরা এ গল্পটিতে আছে গোয়েন্দা কাহিনির মতো অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ, টানটান উত্তেজনা।
নিবন্ধ অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে ছোট ছোট বেশ কিছু লেখা। আছে খনার বচনের অর্থগুলো গল্পের ছলে বলা : ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’ অর্থাৎ মাঘের শেষে বৃষ্টি হলে ফসলের ফলন ভালো হয়। কৃষকের মুখে হাসি ফোটে।
আছে কার্টুন অ্যানিমেশনের আদ্যোপান্ত। একসময়ের হাতে-আঁকা ড্রয়িং থেকে হালআমলের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে কী করে অ্যানিমেশন তৈরি করা হয়, তারই খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়েছে।
আরো আছে, বিশ্বখ্যাত কাটুর্নিস্ট ওয়াল্ট ডিজনির কথা। বর্ণিত হয়েছে, ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন কনস্টেবলের জীবনের কথা। সাফোক অঞ্চলের নিজের গ্রাম ইস্ট বার্গহল্টের ছবি এঁকে বিশ্বকে কী করে মাতিয়ে দিয়েছেন, বলা হয়েছে সেই কথা। তবে এ নিবন্ধে ‘রোমান্টিসিজম আন্দোলন’ শব্দের অর্থটি শিশু-কিশোর পাঠক তো বটেই, প্রাপ্তবয়স্ক অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য লাগতে পারে। যদিও এর ব্যাখ্যায় লেখক উল্লেখ করেছেন : ‘রোমান্টিসিজম আন্দোলন শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে, পশ্চিম ইউরোপে। এই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলায়। এ সময় পুরনো ধ্যানধারণার বাইরে এসে সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সৃষ্টি করতে থাকেন নতুন ধরনের কবিতা, অভিনব সব ছবি বা পেইটিং ও অশ্রুতপূর্ব সংগীত।’ কথাগুলো কেমন যেন আরো দুর্বোধ্য মনে হলো। ঠিক যেন কিশোর-উপযোগী নয়।
আলোচিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের মর্মস্পর্শী জীবনকথা। বাংলাদেশের যশোরের বকচরে তাঁর জন্ম। ১৯৬০ সালে একরকম বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করতে হয় তাঁকে। চলে যেতে হয় ভারতে। অথচ দেশে থাকতে নিজের জমি বিক্রি করে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী কিনেছিলেন দুরবিন, ভাদ্র মাসের রাতের আকাশে তারা দেখবেন বলে। গ্রামের বাচ্চাদেরও তারা দেখাতেন তিনি। শেষ বয়সে এই নিভৃতচারী গুণী মানুষটি অর্থকষ্টে বিনাচিকিৎসায় মারা যান। নিবন্ধের শেষ কয়টি লাইন বড়ো স্পর্শ করল : ‘আজ যশোরে এই মহাত্মার বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। কেউ আর তাকে মনেও রাখেনি। অথচ জীবনের প্রায় সবটুকুই তিনি কাটিয়েছেন এই মাটির ওপর, এই দেশের আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে।’
অধ্যায়ে আরো যুক্ত হয়েছে, চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দ্য কিড’-এর কাহিনী বয়ান। ড্যানি বয়েল পরিচালিত আলোচিত-সমালোচিত ভারতীয় ছবি ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ চলচ্চিত্রের আলোচনা। রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ইয়েফিমোভিচ রাসপুতিনের কথা। এই মানুষটিকে ঘিরে জনশ্রুতি, রহস্যময়তা, অতিকথন এবং জীবনের নির্মম পরিণতিই উল্লেখ করা হয়েছে ছোট পরিসরে। ‘রাসপুতিন ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক’-এ শব্দের অর্থ বা বাক্যের অর্থ বোঝা শিশু-কিশোর পাঠকদের জন্য কষ্টসাধ্য মনে হলো।
আছে গোয়েন্দা কাহিনীর ইতিবৃত্ত। সরকারি দপ্তরের গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে ব্যক্তিগত গোয়েন্দাগিরির (প্রাইভেট ডিটেকটিভ) সব কথা। অধ্যায়ের শেষ লেখা আরভিং ওয়ালেস রচিত ‘সত্যিকার শার্লক হোমস’-এ পাওয়া যায় গোয়েন্দা শার্লক হোমসের জন্মকথা। এ চরিত্রের রচয়িতা স্যার আর্থার কোনান ডোয়েল, পেশায় যিনি ছিলেন ডাক্তার। ডোয়েলের শিক্ষক ছিলেন এডিনবার্গের বিখ্যাত সার্জন ডাক্তার জোসেফ বেল। শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ডোয়েলকে শার্লক হোমস চরিত্র নির্মাণে ভূমিকা রাখে। বেলের সূত্র প্রয়োগ করে পরবর্তী সময় শার্লক হোমস তার কিছু রহস্যজটও খোলে। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তার বেল শিক্ষকতা করেন পঞ্চাশ বছর। ক্লাসে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠ দিতেন অন্যভাবে। বলতেন : ‘তারা (শিক্ষার্থীরা) যদি ভালো চিকিৎসক হতে চায় তা হলে প্রথমে তাদের শিখতে হবে চোখকে কী করে কাজে লাগাতে হয়। অনেকেই চোখে দেখে। কিন্তু তারা পর্যবেক্ষণ করে না। একটা মানুষের দিকে ভালো করে তাকাও, তার চোখ-মুখ দেখো, দেখবে সে কোথা থেকে এসেছে সেই সূত্র খুঁজে পাবে। হাতের দিকে তাকাও, জানতে পারবে সে কী কাজ করে। বাকি গল্প বলে দেবে তার গায়ের জামা- এমনকি কোটে লেগে থাকা একটা সুতাও অনেক সূত্র ধরিয়ে দেবে।’ জীবনের নানা পর্যায়ে ডাক্তার বেল তাঁর প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে উন্মোচন করে গেছেন এক একটি রহস্যজট। চমকে দিয়েছেন মানুষকে।
ধাঁধা অধ্যায়ে আছে মজার ও বুদ্ধিদীপ্ত এক একটি বিষয়। শিরোনামটি করা হয়েছে ‘তুমিই যখন শার্লক হোমস’। টম বুলিমোর নামে একজন একটি বই লেখেন, যার নাম ‘মোর শার্লক হোমস পাজলস’। সেখানে বেশ কিছু ধাঁধা ও রহস্যের জট আছে। গোয়েন্দাগিরি করার জন্য এই অধ্যায়টি বেশ কার্যকর বৈকি! বলা যায়, গোয়েন্দা হওয়ার প্রথম পাঠ। গোয়েন্দাগিরি ১, ২, ৩ সিরিজ করে মোট ১০টি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে এতে। শেষে করা আছে সেগুলোর উত্তর; খোলা হয়েছে সেগুলোর রহস্যজট। শেষাংশে যুক্ত হয়েছে আরো একটি রহস্যগল্প। ডোনাল্ড জে. সোবল-এর লেখা ‘শাওয়ার সিঙ্গারের রহস্য’ গল্পটি অনুবাদ যেন বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে পুরো আবহে। গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্য জালের ভেতর আবার রহস্যে আটকা পড়া যাকে বলে!
হরেক রকম মিষ্টি দ্রব্যের একটি উপাদানের নাম ‘রসগোল্লা’। তবে এ নামের বইটি পড়ে মনে হলো যেন এক রসগোল্লার ভেতর আছে হরেক রকম মিষ্টির স্বাদ। বৈচিত্র্যময় এ শিশু-কিশোর গ্রন্থটি কেবল নির্মল আনন্দই দেবে না, সেই সঙ্গে নানা শিক্ষণীয় উপাদানও ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি লেখাতেই কোনো না-কোনো বার্তা লুকিয়ে আছে তাদের জন্য। বিনোদনের পাশাপাশি কোমলমতি পাঠকদের মানসিক গঠনেও বইটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
রসগোল্লা, লেখক : বিধান রিবেরু; প্রকাশক : কথাপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা; প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৮; প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা; পৃষ্ঠা : ১৫০ টাকা; মূল্য : ২৫০ টাকা।