ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নিতে নির্দেশ
রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার এ রায় ঘোষণা করেন।
এদিন বিচারক দুপুর সাড়ে ১২টায় আদালতের এজলাসে রায় দেওয়ার জন্য উঠেন। এরপরে তিনি নিজ হাতে রায় লেখা শুরু করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা লেখার পর তিনি দুপুর ২টায় রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়ার সময় বিচারক প্রথমে বলেন, ‘আপনারা বলেন মামলাটা আলোচিত। কিন্তু আমার কাছে সব মামলা একই।’
এর পরে, সাক্ষীদের জবানবন্দি বিচারক আদালতে পড়ে শুনান। এ সময় তিনি প্রথমে রেইনট্রি হোটেলে কর্মরত কর্মচারীদের জবানবন্দি পড়ে শুনান। তিনি বলেন, ‘কোনো সাক্ষী ঘটনার দিন ধর্ষণের কোনো ঘটনা দেখেননি। এমনকি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তাও দেখেননি। ঘটনার ৩৮ দিন পরে পুলিশ এসে বললে, তারা ঘটনার কথা শুনেন। সাক্ষীদের এমন বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি বা ভিকটিমরা সেখানে গিয়েছিলো কি না তাও স্পষ্ট নয়।’
এর পরে বিচারক ডাক্তারি রিপোর্টের পর্যালোচনা করেন। এ সময় বিচারক বলেন, ‘ঘটনার ৩৮ দিন পরে মামলা হয়েছে। এত দীর্ঘদিন মামলা করার কারণে, মেডিকেলে কোনো ধর্ষণের আলামত আসেনি। এ ছাড়া ভিকটিম শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্থ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই মেডিকেল রিপোর্টেও কোনো ধর্ষণের প্রমাণ হয়নি। এবার ভিকটিমের ঘটনার দিন পরিহিত লং কামিজ পুলিশ জব্দ করে এবং তা কেমিকেল টেস্ট করানো হয়েছে। সেখানেও কোনো ধরনের বীর্য পাওয়া যায়নি। অতএব এতেও স্বীকৃত যে, ধর্ষণ হয়নি।’
বিচারক পরবর্তীতে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে বলেন, আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের আশ্বস্ত করেননি, আসামিরা যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দেন তাহলে তাদের আর রিমান্ড দেওয়া হবে না। এতে স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া ছিলো বলে প্রতীয়মান হয় না। এ ছাড়া আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া, ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে কে কীভাবে জড়িত তা আসামিরা ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে সুষ্পষ্টভাবে বলেননি। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে জোরপূর্বক ধর্ষণ বা প্রতারণামূলকভাবে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না তা পরিষ্কার হয়নি।
বিচারক এ সময় বলেন, ‘মামলা ফাইল হয়েছে ঘটনার ৩৮ দিন পর। মেডিকেলে ধর্ষণের কোনো আলমত নেই এবং কাপড়ে বীর্যের আলামত নেই। এ মামলায় আদালতের সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। ৯৩টি কার্যদিবসে আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে। এ মামলায় ভিকটিম আগে থেকে শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্থ। এ মামলায় প্রভাবিত হয়ে তদন্ত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তাও।’
বিচারক এ সময় পর্যালোচনায় বলেন, ‘ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পরে কেউ মামলা নিয়ে এলে পুলিশ যাতে মামলা রেকর্ড না করে সে বিষয়ে পর্যালোচনায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হোটেলে ভিকটিমরা স্বেচ্ছায় থাকতে গিয়েছেন। তারা ধর্ষণের শিকার হয়নি। এ ছাড়া, এক নম্বর আসামি (সাফাতের) সদ্যডিভোর্সি স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
বিচারক আরও বলেন, ‘ভিকটিমরা যদি সত্যিকারের ধর্ষণের শিকার হতেন তাহলে সর্বপ্রথম তাদের কাজ হতো আগে থানায় যাওয়া। তাই অত্র আদালত মনে করে অত্র মামলায় আসামিরা নির্দোষ। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে মামলা প্রমাণ করতে পারে নাই, তাই আসামিদের খালাস দেওয়া হলো।’
রায় শোনার পর আসামিরা বিচারককে সালাম দেন এবং আলহামুদিল্লাহ বলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। এরপরে তাদের আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ তাদের খালাসের আদেশ কারাগারে পোঁছালে আগামীকাল শুক্রবার সকালে মুক্তি দেওয়া হবে।
এ মামলার পাঁচ আসামি হলেন—সাফায়েত আহমেদ সাফাত, তাঁর বন্ধু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ই-মেকার্স’-এর কর্মকর্তা নাঈম আশরাফ, রেগনাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন এবং দেহরক্ষী রহমত আলী।
এর আগে গত ৩ অক্টোবর রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করে পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠান বিচারক। এর পর থেকে তাঁরা কারাগারে আটক রয়েছেন।
রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ এনে ২০১৭ সালের ৬ মে বনানী থানায় মামলা করেন এক ছাত্রী।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তাঁর বান্ধবী ও বন্ধু শাহরিয়ারকে আটক রাখেন। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে জোর করে ঘরে নিয়ে যান আসামিরা।
এজাহারে আরও বলা হয়, বাদীকে সাফাত আহমেদ একাধিকবার এবং বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। আসামি সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তাঁর মাধ্যমেই ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই ছাত্রীর পরিচয় হয়।
এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন সাফাতের জন্মদিনে দুই ছাত্রী যান। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাঁদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তাঁর বান্ধবী জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। তাঁদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে। সেখানে যাওয়ার পর তাঁরা ভদ্র কোনো লোককে দেখেননি। সেখানে আরও দুই তরুণী ছিলেন। বাদী ও বান্ধবী দেখেন, সাফাত ও নাঈম ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তাঁরা চলে যেতে চান। পরে আসামিরা তাঁদের গাড়ির চাবি শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। এরপর তাঁকে খুব মারধর করেন।
এতে আরও বলা হয়, ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন এবং তিনি প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এর পর বাদী ও বান্ধবীর বাসায় দেহরক্ষী পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাঁরা এতে ভয় পেয়ে যান। পরে লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এতে মামলা করতে বিলম্ব হয়।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী কী ঘটেছিল সেদিন?
২০১৭ সালের ৮ জুন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে সাফাতসহ পাঁচ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যানি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার ১৫ দিন আগে গুলশানের পিকাসো হোটেলে সাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয় বাদীর। সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে বাদী ও ভিকটিমের মামলার ঘটনায় ১০/১৫ দিন আগে বাদীর পূর্ব পরিচিত বন্ধু সাদমান সাকিফের মাধ্যমে গুলশান থানাধীন পিকাসো হোটেলে পরিচিত হয়।
পরিচয় হওয়ার পর সাফাত আহমেদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে অনেকদিন কথা হয়। কথা হওয়ার মাঝে সাফাত আহমেদ ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ তাঁর জন্মদিনের প্রসঙ্গ তুলে বাদীকে তাঁর বান্ধবীসহ অন্য বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে রেইনট্রি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আসার জন্য দাওয়াত দেন। ঘটনার দিন সাফাত আহমেদ তাঁর নিজের ব্যবহৃত গাড়ি ও ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন এবং গানম্যান রহমতকে পাঠান বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে তাঁদের নিজ বাসা নিকেতন থেকে রাত ৯টায় রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন এবং ড্রাইভার বিল্লাল তাঁদের হোটেল রুমে পৌঁছে দিয়ে আসেন। হোটেলে আসার পর ওখানে কোনো পার্টির পরিবেশ না দেখে বাদী ও তাঁর বান্ধবী চলে যেতে চাইলে আসামিরা বান্ধবী ও বাদীকে কেক কেটে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেখানে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও স্নেহা ছিলেন। বাদী তাঁর বন্ধুদের নিয়ে আবার চলে যেতে চাইলে সাফাত ও নাঈম বাদীর বন্ধুদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং বাদীর বন্ধু শাহরিয়ারের গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন। এরপর শাহরিয়ারকে ৭০৩ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন। পরে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ রেইনট্রি হোটেলের ৭০০ নম্বর সুইট রুমে বাদী ও ভিকটিমকে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে সাফাত ও নাঈম আশরাফ ধর্ষণ করেন। এ সময় বাদীকে খুব মারধর করেন। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তাঁর বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন। এরপর বাদী ও তাঁর বান্ধবীর বাসায় রহমত আলীকে পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাঁরা এতে ভয় পান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁরা মামলার সিদ্ধান্ত নেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার একদিন আগে সাফাত পার্টির জন্য মদের বোতল রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন। ধর্ষণের পর সাফাত আহমেদের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন ওষুধের দোকান থেকে আইপিল (জন্মনিরোধ) সংগ্রহ করে আনেন। পরবর্তী সময়ে সাফাত আহমেদ জোর করে বাদীকে আইপিল খাওয়াতে চান। কিন্তু বাদীনি আইপিল খেতে না চাইলে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও বাদীকে সাফাত ও নাঈম মারধর করে। এ মারধরের ঘটনা নাঈমের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল মোবাইলে রেকর্ড করে রাখেন। পরে সে ভিডিওগুলো তাঁরা ডিলিট করে দেন। পুলিশি তদন্তের সময় মোবাইল থেকে ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সে ভিডিওগুলো উদ্ধার করা হয়।