স্বপ্নের মেট্রোরেলে কিছু সময়
বর্ণিল আকাশে মিষ্টি রোদের আভা। টেবিলঘড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই ৬টা বেজে ৩০ মিনিট। প্রাতঃকালীন কাজ সেরে চটজলদি অফিসের দিকে ছুটলাম। আগের দিনই অ্যাসাইনমেন্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল অফিস থেকে। কারওয়ান বাজারে অফিসে এসে আবার ৯টার মধ্যেই পৌঁছাতে হবে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। যেখান থেকে যাত্রা শুরু করবে স্বপ্নের মেট্রোরেল।
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় মেট্রোরেল উন্নত বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও দৃষ্টিনন্দন একটি বাহন। দ্রুত গতিতে সময়মতো যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে এ বাহন অতুলনীয়। এমন একটি বাহনে চড়ে অফিসে আসাযাওয়া করবেন, রাজধানীবাসীর এটি একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এ স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সূর্যোদয়ের দেশখ্যাত সূদুর জাপান থেকে মেট্রোরেলের কোচ এখন ঢাকায়। এ কোচের ট্রায়াল রান হবে। এ ট্রায়াল রানের সাক্ষী হব, মনে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল তখন।
সেদিন ছিল সোমবার, ২৯ আগস্ট। সকাল সাড়ে ৭টায় অফিসে এসে পেলাম সহকর্মী ফটোসাংবাদিক সাইফুল সুমন ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম ভাইকে। আমরা একসঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে যাওয়ার কথা।
অফিস থেকে নেমে একসঙ্গে তিনজন গাড়ি চেপে বসলাম। আকাশে একটু মেঘলা মেঘলা ভাব। কিছুক্ষণ পরে রিমঝিম বৃষ্টি নেমে এলো। অফিস টাইম। শহরে প্রায় সব গাড়িই সকালে বের হয়। আবার ফেরে সন্ধ্যায়। তাই এ দুই বেলায় যানজট একটু বেশিই থাকে। গাড়ির কাচ দিয়ে ফোঁটাফোঁটা বৃষ্টি দেখছি। মনে পড়ল, মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ইতোপূর্বে দেওয়া বক্তব্য, ‘মাত্র চল্লিশ মিনিটে উত্তরা থেকে সেই মতিঝিল যাওয়া যাবে এ মেট্রোরেলে চড়ে’। কথাটি মনে হতে বেশ ভালো লাগল নিজের কাছে।
এদিকে, গাড়িতে সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস চলছে স্বপ্নের মেট্রোরেল নিয়ে। আমার চোখ তখনও গাড়ির কাচ দিয়ে বাইরে। হঠাৎ করেই বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ ভেদ করে আবারও সূর্যি মামা হাসির আলো ছড়িয়ে দিল শহরজুড়ে। আমরাও পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ির ডিপোতে। দিয়াবাড়ি থেকে ডিপোতে প্রবেশের মুখেই মেট্রোরেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিষ্টি হাসিতে অভ্যর্থনা জানাতে আমাদের পথনিদের্শনাও দিচ্ছেন। তাঁদের সবার চোখেমুখে এক ধরনের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যাচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে ডিপোতে প্রবেশ করতেই চোখের সামনে দেখতে পেলাম লাল-সবুজ মিশ্রিত সাদা রঙের স্বপ্নের মেট্রোরেল। নিজের অজান্তে মেট্রোরেলের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম, চোখের কোণে আনন্দ-অশ্রু, অপলক তাকিয়ে রইলাম অবাক দৃষ্টিতে। পেছন থেকে সহকর্মী সুমন ভাই কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠলেন, চলেন সামনে যাই। সামনে কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল, সংবাদকর্মী রেল কর্মকর্তারা সবাই স্বপ্নের মেট্রোরেল নিয়ে আনন্দে ছবি তুলছেন যে যাঁর মতো। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন কীভাবে চলবে, কত টাকা ভাড়া হবে, কীভাবে যাত্রী ওঠানামা করবে, সময় কত লাগবে, কবে যাত্রী তুলবে সে সব বিষয় নিয়ে। কেউ আবার এই বিশেষ মূহূর্তটাকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছেন। কেউ বা মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছেন। নিজেও এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। নিজেও ক্যামরাবন্দি হলাম।
এদিকে, সবার মতো করে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন পরীক্ষামূলক ভাবে সূচনা হবে মেট্রোরেলের চলাচল। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঞ্চে আসন নিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনিও ঘুরেঘুরে দেখলেন মেট্রোরেলের ভেতরের অংশ। তাঁর চোখমুখেও আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
মেট্রোরেলের ট্রায়াল রান উদ্বোধন করে সেতুমন্ত্রী যানজটমুক্ত নগরী উপহার দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের কথা নগরবাসীকে আরেক বার স্মরণ করিয়ে দেন। মনে করিয়ে দেন ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আওয়ামী লীগের দিনবদলের নির্বাচনি ইশতেহার আর ভিশন ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১-এর কথা। যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছেন তা আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তবায়নের পথে।
১১টা ৫০ মিনিটে চিরাচরিত সবুজ পতাকা ওড়ালেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী। মেট্রোরেলের হুইসেল বাজালেন জাপানি চালক। তাঁর সহযোগিতায় ছিলেন বাংলদেশের কয়েক জন রেলকর্মী। চলতে শুরু করল আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল। করতালি দিয়ে স্বাগত জানালেন উপস্থিত সবাই। আশপাশের ভবনগুলো থেকে নগরবাসীও তাঁদের স্বপ্নের মেট্রোরেলকে হাত নেড়ে স্বাগত জানালেন। আর মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করল আমার সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর ৫৬টি দেশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। সে সব দেশের তালিকায় এবার আমরাও প্রবেশ করলাম স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে।
২০০৯ সালে সরকার গঠন করে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ‘মেট্রোরেল প্রকল্প’ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রকল্প ঋণ ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ২৫ শতাংশ। ২০১৬ সাল থেকে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়। আর পরীক্ষামূলক চলাচলের শুভ সূচনা করে গত ২৯ ডিসেম্বর।
মেট্রোরেল ছাড়াও সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার আরও দুটি প্রকল্প রয়েছে : দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু আর চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল। এ তিন মেগা প্রকল্পের সুবিধা নিতে অপেক্ষা বছর নয়, মাত্র কিছু দিন।
করোনা মহামারির থাবায় থমকে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রভাব পড়েছে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবনে। তবুও একটি দিনের জন্য থেমে থাকেনি সরকারের এ তিন উন্নয়ন প্রকল্প।
মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল; এ তিন মেগা প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আর জিডিপির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। অর্থনীতির চাকা হবে ঊর্ধ্বমুখী। উন্নয়নশীল দেশ থেকে পৌঁছে যাব উন্নত রাষ্ট্রে। বাস্তবায়িত হবে পিতা মুজিবের সোনার বাংলাদেশ তথা তরুণ প্রজন্মের আইকন পিতা মুজিবের দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ।
লেখক : সংবাদকর্মী