অভিমত
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক ও নৈতিক দিক
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন যেদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) আবারও সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়, তার পরদিন দুপুরে পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে বড় বোন ফোন করে জানালেন, বাসায় অতিথি এসেছে, কিন্তু গরুর মাংস চড়ানোর পর যে হারে চুলা জ্বলছে, তাতে ডিম রান্না করাও কঠিন।
এই অভিজ্ঞতা রাজধানীর সব এলাকায় মোটামুটি একই রকম। সকাল ১০টার পরে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। দুপুরের দিকে তা প্রায় শূন্যে নেমে যায়। বিশেষ করে শুক্র-শনিবার। ফলে অনেকেই সকাল ও দুপুরের রান্না করে রাখেন আগের রাতে। অনেকে পাইপলাইনের গ্যাসের বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাস, জ্বালানি কাঠ ও বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করেন। ফলে জ্বালানির খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
এটা ঠিক, আমরা যত কম পয়সায় পাইপলাইনের গ্যাস পাই, তা পৃথিবীতে বিরল। মাত্র সাড়ে ছয়শো টাকায় সারা মাস দুই চুলার গ্যাস (আগামী জুন থেকে হবে সাড়ে নয়শো টাকা)। এমনও বলা হয় যে, মানুষ সাড়ে ছয়শো টাকা বিল দিলেও আসলে গ্যাস পোড়ে দুই হাজার টাকার। কারো কারো ক্ষেত্রে এই কথা হয়তো সত্যি। বিশেষ করে যারা গ্যাসের চুলার ওপর কাপড়-চোপড় শুকান। কিন্তু এর বাইরে অধিকাংশ মানুষকেই আসলে সারা মাস কাঙ্ক্ষিত চাপে গ্যাসের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়। ফলে দেখা যায়, অনেকেই সারা মাসে যে গ্যাস ব্যবহার করেছেন, তার দাম হয়তো ২০০ টাকা। কিন্তু তাকে বিল দিতে হচ্ছে সাড়ে ছয়শো টাকা।
আবার মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও আসলে মূল্য সমন্বয় হয়েই আছে। কারণ যারা এখন মাসে দুই চুলার গ্যাসের জন্য সাড়ে ছয়শো টাকা বিল দেন, তারা সিলিন্ডার, কাঠ বা বৈদ্যুতিক চুলাসহ এ রকম বিকল্প মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবহার করতে গিয়ে মাসে খরচ করেন প্রায় দুই হাজার টাকা বা তারও বেশি।
এবার একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। তারা বলছে, যার বাড়িতে গ্যাস নেই তিনি জ্বালানি বাবদ মাসে ব্যয় করেন তিন হাজার টাকা। আর যাদের বাড়িতে গ্যাস সংযোগ আছে তারা ব্যয় করেন সাড়ে ৬০০ টাকা। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে এটা চলতে পারে না।
বিষয়টা ঘি ও সয়াবিন তেলের মতো। ঘিয়ের কেজি এক হাজার টাকা। আর সয়াবিন তেলের লিটার ১০০ টাকা। তো সরকার যদি আগামীকাল থেকে ঘিয়ের সঙ্গে সয়াবিন তেলের দাম সমন্বয়ের জন্য সয়াবিন তেলের লিটার ৫০০ টাকা করে দেয়, সেটি কেমন হবে?
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, গ্যাসের মজুদ কমে আসছে, তাই ধীরে ধীরে বিকল্প জ্বালানির দিকে যেতে হবে এবং পাইপলাইনের গ্যাস পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে কারণে ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়ে সেই বাড়তি অর্থ দিয়ে গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়ন করা হচ্ছে। এটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত এবং ভালো যুক্তি। কিন্তু নৈতিকতার বিচারে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মানুষ যদি প্রতিদিন তার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্যাস পেত এবং তাকে যদি গ্যাসের চাপ না থাকায় বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে বাড়তি পয়সা খরচ করতে না হতো, তাহলে দুই চুলা গ্যাসের বিল সাড়ে ৯০০ টাকা দিতে মানুষের বোধ হয় আপত্তি থাকত না। আবার যখন এরকম গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, সেখানে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা বিবেচনায় থাকলেও, নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা বিবেচনার বাইরে থাকে বলে প্রতীয়মান হয়।
দুই চুলার গ্যাসে ৩০০ টাকা বাড়তি বিলের অর্থ শুধু এই ৩০০ টাকাই নয়। বরং যখনই গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়, তখনই বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেন। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ বাড়ে। ফলে বেড়ে যায় জিনিসপত্রের দাম। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজিচালিত যানবাহনের খরচ বাড়ে। ফলে বেড়ে যায় পাবলিক পরিহনের ভাড়া। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই খরচ বাড়ে। তার মানে ৩০০ টাকা গ্যাসের মূল্য বাড়া মানে আখেরে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপে বাড়তি অন্তত দুই হাজার টাকার বোঝা।
অতএব গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন কিংবা দাম সমন্বয়- যে যুক্তিতেই দাম বাড়ানো হোক না কেন, সেবার মান না বাড়ানো হলে অর্থাৎ মানুষ তার চাহিদামতো গ্যাস না পেলে তার ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই নৈতিক নয়।
অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে, পাইপলাইনের গ্যাস বন্ধ করে সিলিন্ডার গ্যাস সহজলভ্য করা হবে। এটি নিয়েও একটা তুমুল সংকট তৈরি হবে। শুধু ঢাকা শহরের উদাহরণ দিয়েই বলা যায়, এই শহরে যদি আড়াই কোটি মানুষও থাকে, তাহলে এই বিপুলসংখ্যক মানুষ তার সময়মতো সিলিন্ডার গ্যাস পাবে না। এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠবে সিন্ডিকেট। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা এক হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি করবে তিন হাজার টাকায়। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কারণ সব ডিলার এবং এই সিন্ডিকেটে যারা জড়িত থাকবে, সঙ্গত কারণেই তারা থাকবে সরকার ও সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং জ্বালানি খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আগে যদি সত্যি সত্যিই পাইপলাইনের গ্যাস বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেটি যে ভয়াবহ সংকটের জন্ম দেবে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।